সামর্থ্য থাকলেও বেতন দেয়নি তোবা গ্রুপ

বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে গতকাল রাজধানীর বাড্ডায় হোসেন মার্কেটের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল করতে চাইলে তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের বাধা দেয় পুলিশ l ছবি: প্রথম আলো
বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে গতকাল রাজধানীর বাড্ডায় হোসেন মার্কেটের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল করতে চাইলে তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের বাধা দেয় পুলিশ l ছবি: প্রথম আলো

তোবা গ্রুপ গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৩৯ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করেছে। নতুন কার্যাদেশ পেয়েছে দুই কোটি টাকার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও মালিকপক্ষ এই তথ্য দিলেও গ্রুপের পাঁচ কারখানার এক হাজার ৬০০ শ্রমিক বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
মে, জুন ও জুলাই মাসের বেতন, ওভারটাইম এবং ঈদ বোনাস বাবদ শ্রমিকদের পাওনা চার কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১২৭ টাকা। তবে মেরুল বাড্ডায় গ্রুপের আরেক কারখানা তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা মজুরি নিয়মিত পাচ্ছেন।
পোশাকশ্রমিকেরা বলছেন, সামর্থ্য থাকলেও বেতন-ভাতা না দিয়ে মালিকপক্ষ তাঁদের জিম্মি করে তোবার মালিক দেলোয়ার হোসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে চেয়েছে। মালিকপক্ষের প্ররোচনায় আন্দোলনে নেমে পুলিশের গুলি খেয়েছেন তাঁরা। এক শ্রমিকনেতার কথায় আবার রাস্তায় নেমে বিজিএমইএ কার্যালয় ঘেরাও করেছেন পাঁচবার। পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দেড় মাস আগে তোবার পাঁচ কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা করে বিষয়টি শুধু সরকারকে জানিয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করেছে। নিজেরা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। উল্টো দেলোয়ারকে মুক্ত করতে বিজিএমইএর কোনো কোনো নেতা উসকে দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেন শ্রমিকেরা।
শ্রমিকেরা দিনভর বিজিএমইএর ভবন অবরুদ্ধ করে রাখলে গত ২৪ জুলাই কারখানার দুটি ফ্লোর বিক্রি করে পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন বিজিএমইএর নেতারা। যদিও এসব ফ্লোর একটি বেসরকারি ব্যাংকে আগেই বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন দেলোয়ার।
তার পরও বেতন-ভাতা না পেয়ে ঈদের আগের দিন থেকে আমরণ অনশন করছেন তোবার পোশাকশ্রমিকেরা। গতকাল শনিবার ষষ্ঠ দিনের মতো অনশন করেছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত অসুস্থ হয়েছেন ৯২ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন নয়জন শ্রমিক।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় বিজিএমইএ সংকট সমাধানে গতকাল শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হকের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেছে। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেলোয়ার মুক্তি পেলেও সে টাকা দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। কারণ, পুরো বিষয়টি নেতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে। এ মুহূর্তে ব্যাংক ঋণ না-ও দিতে পারে।’ বিজিএমইএর এই নেতা আরও বলেন, ‘পোশাকশিল্পের বড় বড় গ্রুপের কাছ থেকে টাকা ধার করে হলেও বৃহস্পতিবারের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের চিন্তাভাবনা করছে বিজিএমইএ। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে প্রশাসনিক সহায়তা চেয়েছি।’
মালিকের মুক্তির জন্য: এপ্রিল ও মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিশ্বকাপের জার্সি তৈরি হয় তোবার পাঁচ কারখানায়। তার পর থেকে ঠিকায় আনা গেঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করেন। এখনো হোসেন মার্কেটের নিচে গুদামঘরে অনেক কাপড় পড়ে আছে।
এসব তথ্য দিয়ে তোবা গ্রুপের তায়েব ডিজাইনের লাইন চিফ জ্যোতি সরকার বলেন, ‘বিশ্বকাপের আগে আমরা ২৬ কোটি টাকার জার্সির কাজ করেছি। তারপর সাব কন্ট্রাক্টের কাজ করছি। এপ্রিল-মে মাসে যে কাজ করছি, সেই টাকা দিয়েই দু-তিন মাসের বেতন দেওয়া যায়। তার পরও কেন দেওয়া হচ্ছে না, বুঝতে পারছি না।’
শ্রমিক মো. হারুন বলেন, ‘মালিক দেলোয়ার হোসেনকে মুক্ত করার জন্য আমাদের ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা ভুল বুঝতে পেরেছি। তাঁর শাস্তি হওয়া দরকার। না হলে মালিকেরা অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবেন। তবে তার আগে অবশ্যই আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।’
জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই দেলোয়ার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র কারাগারে না পৌঁছায় তিনি মুক্ত হননি।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১১১ জন পোশাকশ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় করা মামলায় জামিন নিতে গেলে আদালত গত ৯ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেনকে কারাগারে পাঠান।
‘শ্রমিকেরা কেঁদে মরে, প্রধানমন্ত্রী ঈদ করে’: বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে অনশনরত তোবা গ্রুপের পোশাকশ্রমিকদের একাংশ গতকাল বেলা ১১টায় হোসেন মার্কেটের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। কয়েক শ শ্রমিকের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়, যার একটি ছিল,‘শ্রমিকেরা কেঁদে মরে, প্রধানমন্ত্রী ঈদ করে’।
তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির পূর্বঘোষিত এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকে পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। বিক্ষোভ ঠেকাতে দুটি জলকামানও মজুত রাখা হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে মিছিল করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। সে সময় সামান্য হাতাহাতি হয়। এর বাইরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সমাবেশে ‘তোবার শ্রমিকদের সংগ্রাম চলছেই, চলবেই’; ‘শ্রমিকের বেতন-বোনাস দিতে হবে, দিতে হবে’; ‘খুনি দেলোয়ারের ফাঁসি চাই’; ‘জেগেছেরে জেগেছে, শ্রমিকশ্রেণি জেগেছে’—এমন সব স্লোগান দেন শ্রমিকেরা।
সমাবেশে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, বেতন-বোনাস না পেয়ে তোবার শ্রমিকেরা যে অনশন করছেন, তার দায় বিজিএমইএর যেমন আছে, তেমনি সরকারের আছে। সরকার যখন শ্রমিকদের জন্য টাকা তুলে তা শ্রমিকদের দেয় না, তখন পোশাকমালিকেরাও শ্রমিকদের টাকা না দেওয়ার সাহস পান।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের নেতা মাহবুবুর রহমান, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রাজেকুজ্জামান রতন প্রমুখ।
আমরণ অনশন চলছে: আমরণ অনশনের ষষ্ঠ দিনে গতকাল নতুন করে পাঁচ শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। শাহিদা নামে একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে অসুস্থ শ্রমিকের সংখ্যা ৯২-তে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন হাসপাতালে ভর্তি। তবে কোহিনূর বেগম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার অনশনে যোগ দিয়েছেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশুকে গতকালও অনশনমঞ্চে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ছয় দিন ধরে অনশন করছি। আর বিজিএমইএ আরও সাত দিন সময় চাইছে। এটা তামাশা ছাড়া আর কিছু না। যদি একজন শ্রমিকেরও ক্ষতি হয়, তবে সে জন্য সরকার দায়ী থাকবে।’