সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ

>

১৯ জানুয়ারি, ২০১৬ প্রথম আলো ও ইপসার আয়োজনে ‘সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l প্রথম আলো

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: নেতৃত্ব সহজাত ব্যাপার। তবে একটি দলের মধ্যে কেউ না কেউ নেতৃত্বের হাল ধরেন। দেখা যায়, অন্যরা তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেন এবং তিনিই দল পরিচালনা করেন। আর নেতৃত্ব সব সময় প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি হয় তাও নয়। অনুকূল পরিবেশ ও সমাজ থেকে প্রেরণা পেলে নেতৃত্বের সুপ্ত গুণাবলি প্রকাশ পায়।

সামাজিক নেতৃত্বকে নানা কাজে লাগানো যায়। এই মুহূর্তে সামাজিক নেতৃত্বের বিকাশ অনেক বেশি প্রয়োজন। কারণ, আমাদের সমাজ এখন নানা রকম ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও হচ্ছে।
এ জন্য যদি নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক তৈরি করা যায়, তাহলে তাঁরা ঘূর্ণিঝড়ের সময় যেমন এগিয়ে আসবেন, তেমনি ইভ টিজিং, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম প্রতিরোধে কাজ করবেন।
সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ নেতৃত্ব দিতে পারেন না। তাঁর পক্ষে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও কঠিন।

ওবায়দুল করিম
ওবায়দুল করিম

ওবায়দুল করিম: দেশের উন্নয়নে তরুণ ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নেতৃত্বের। নেতৃত্ব বিকশিত হবে সংগঠনের মাধ্যমে। একটি সংগঠনে অবশ্যই একজন নেতা থাকতে হবে। অনেকে জন্মগতভাবে, অনেকে সামাজিকভাবে নেতৃত্ব শিখে নেন। তাঁরা জানেন কীভাবে আর দশজনকে অনুপ্রাণিত করবেন। আর আপনি তখনই নেতা হবেন, যখন অন্যদের প্রভাবিত করতে পারবেন। আপনার আচরণ ও উদ্দেশ্য সমাজের আর দশজন মানুষ অনুসরণ করবে। আমাদের এখানে নেতা আছে, কিন্তু উৎসাহ দেওয়ার মন-মানসিকতা নেই। যেমন নিজের নিজেকেই পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সে রকম উৎসাহ দিতে পারছি না। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে, যৌতুক সমস্যা। এর বিরুদ্ধে সব সময় বলা হচ্ছে। পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু তার পরও যৌতুক প্রথা বন্ধ হচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে তরুণদের মোটিভেট করার জন্য কাজ করতে হবে।

আমীর এম নসরুল্লাহ
আমীর এম নসরুল্লাহ

আমীর এম নসরুল্লাহ: নেতৃত্বের সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়নের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশের জন্য প্রথমেই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তাঁর মধ্যে থাকতে হবে অন্যদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা। তাঁকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। ঘটনার প্রতি তাঁর কৌতূহল ও যোগাযোগ দক্ষতা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। না হলে তাঁর কাজ প্রকাশ পাবে না।
এ ছাড়া একজন নেতাকে চিন্তা করতে হবে, ঝুঁকি নিতে হবে। অনেক সময় নেতাকে তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকেও শিখতে হবে, যা তিনি সমাজের প্রয়োজনে প্রয়োগ করবেন।
একজন নেতার আত্মসচেতনতা জরুরি। কথা বলার সময় সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে। এখন দেখা যায়, অনেক নেতা না জেনে কথা বলে ফেলেন। নেতার কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকতে হবে। না হলে অনুসারীরা তাঁকে অনুসরণ করবে না।

দেলোয়ার মজুমদার
দেলোয়ার মজুমদার

দেলোয়ার মজুমদার: নেতৃত্ব দুই ধরনের হতে পারে—একক ও যৌথ। যৌথ নেতৃত্ব বিধিবিধান মেনে চলে। আবার অন্যদের ব্যর্থতার জন্য যৌথ নেতৃত্ব ভেঙে একক নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়।
কেউ কেউ বলেছেন, নেতৃত্ব সহজাত। আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই জন্মগতভাবে নেতৃত্ব গুণাবলি আছে। কারও কারও মধ্যে নেতৃত্বের সেই গুণাবলি ও যোগ্যতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এ জন্য নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত করে উৎকর্ষ সাধন করা এবং তা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রশিক্ষণ ও পড়ালেখার প্রয়োজন রয়েছে। ইপসা এখানে হাত দিয়েছে। তারা নেতৃত্বের গুণাবলি জাগিয়ে তোলার কাজ করছে।
নেতৃত্বের অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে, তিনি নিজে নেতৃত্ব দেবেন, অন্যের নেতৃত্ব মেনে চলবেন। তাঁর মধ্যে এই অনুভূতি থাকতে হবে। নেতৃত্ব মানে প্রভুত্ব নয়। তাঁর মধ্যে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাঁর কথা অনুসারীদের বোধগম্য হতে হবে। নেতা অবশ্যই জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা প্রয়োজন। তাঁর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। তাঁকে সৎ হতে হবে।
নেতাকে জ্ঞানী হতে হবে। থাকতে হবে দৃঢ়তা ও আবেগ। না হলে তিনি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারবেন না। আর নেতৃত্ব বিকাশের জন্য জ্ঞানচর্চার জায়গাটি উন্মুক্ত রাখতে হবে। আমাদের এখানে পরমতসহিষ্ণুতা একেবারেই অনুপস্থিত। এই ধারার পরিবর্তন দরকার।

এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী
এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী

এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী: আমরা ছাত্ররাজনীতি করে এই পর্যায়ে এসেছি। আমাদের সময় নেতৃত্বের বিকাশের জন্য তৃণমূল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। আমাদের লক্ষ্য ও আদর্শের ব্যাপারে তাঁদের মোটিভেট করতাম। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই।
ইপসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তৃণমূল থেকে তরুণ ও যুবসমাজকে নেতৃত্বের জন্য উঠিয়ে নিয়ে আসা। তারা তরুণ ও প্রবীণের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি ভালোভাবেই করছে। আমার ইউনিয়নের প্রত্যেক ওয়ার্ডে নয়জন করে যুব ও প্রবীণ প্রতিনিধি বাছাই করে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন তঁারা সমাজের বিভিন্ন অপকর্ম, বাল্যবিবাহ ও যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলছেন। আত্মকর্মসংস্থানের জন্যও কাজ করছে ইপসা। পাড়া, মহল্লা ও ইউনিয়নে যদি নবীন-প্রবীণের সমন্বয় করে প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করে তোলা হয় তাহলে তারা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করবে। আর যুবকেরাই সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে।

আনোয়ারা আলম
আনোয়ারা আলম

আনোয়ারা আলম: আমাদের সমাজে যৌতুকপ্রথা, বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিংয়ের মতো সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এসবের বিরুদ্ধে তরুণসমাজকে কাজ করতে হবে। নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে তাঁদের। এই তরুণেরাই ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের নেতৃত্বে আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি।
কিন্তু একুশ শতকে এসে আবার আমাদের কেন নেতৃত্বের বিকাশের কথা বলতে হচ্ছে? কারণ, অনেকগুলো সংকট রয়ে গেছে।
নেতৃত্বের অনেক গুণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিজের ভেতর তাগিদ থাকতে হবে। আজকের বৈঠকে নেতৃত্বের বিকাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা আসছে। আমার কথা হচ্ছে, নেতৃত্বের বিকাশে শিক্ষকেরা কি সেভাবে কাজ করছেন, নাকি তাঁরা সুবিধাবাদী হয়ে গেছেন? শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন কিংবা একজন শিক্ষক যখন সুবিধার জন্য দল করেন তখন একজন শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের মর্যাদা ও শ্রদ্ধা থাকবে না। সৎ ও নীতিমান শিক্ষকেরা নেতৃত্বের বিকাশের জন্য শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
নেতৃত্বের বিকাশের জন্য তরুণদের সুশিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার আলোয় তাঁরা পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকপ্রথা ও বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ করে যাবেন। তবে এ জন্য অনেক বেশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। এই চর্চা যত বাড়বে মননশীলতা তত বাড়বে। মননশীলতার সঙ্গে নেতৃত্বের সম্পর্ক রয়েছে।
যে তরুণটি ভালো কাজ করবেন, তাঁকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পুরস্কার দিতে হবে। তাহলে তাঁরা ভালো কাজ করতে উৎসাহিত হবেন।

রেহেনা বেগম
রেহেনা বেগম

রেহেনা বেগম: সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব না থাকলে কোনো কিছুই রক্ষা করা যাবে না। একজন নেতা যদি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য না বোঝেন, তাহলে নেতৃত্ব দেবেন কীভাবে। তিনি তো কালোটাকার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন।
নেতৃত্ব বিকাশের জন্য পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখানে তা কতটুকু অনুকূলে রয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দেশে কয়েক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এক দেশে একাধিক শিক্ষাব্যবস্থা থাকতে পারে না। তরুণদের সুপ্ত প্রতিভা ও চিন্তা যাতে বিকাশ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
সর্বোপরি সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী-পুরুষের বৈষম্য রাখা যাবে না।

মো. আরিফুর রহমান
মো. আরিফুর রহমান

মো. আরিফুর রহমান: বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি যুবসমাজ। এখানে অত্যন্ত কর্মক্ষম, সৃজনশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল একটি যুবক গোষ্ঠী রয়েছে। তাঁদের যদি ‘ড্রাইভিং ফোর্সে’ নিয়ে আসা যায়, তাহলে বাংলাদেশ শুধু মধ্যম আয়ের দেশ হবে না, একই সঙ্গে জীবনমানের দিক থেকেও মধ্যম স্তরে পৌঁছে যাবে।
এদিকে মধ্যম আয়ের দেশ হলেই দেশের দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূর হবে না। অর্থনৈতিকভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হবে ঠিকই কিন্তু জীবনমানের দিক দিয়ে সে জায়গায় পৌঁছানো সহজ নয়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, সে জায়গায় পৌঁছানো। যুবকেরাই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমরা সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে কাজ করি। সরকারের ভালো কাজ, আইন ও বিধি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কাজ করছি।
আমরা লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির জন্য ১৭টি ইউনিয়নকে বেছে নিয়েছি। ইপসার কার্যক্রম চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলা ও ঢাকায় বিস্তৃত হয়েছে। প্রায় পাঁচ শ ইউনিয়নে ইপসার সরাসরি কাজ রয়েছে। তার মধ্যে ১৭টি ইউনিয়নকে বাছাই করার বিশেষ কারণ রয়েছে।
আমরা চাই, প্রতিশ্রুতিশীল ও শিক্ষিত মানুষগুলো রাজনীতিতে আসুক। তাঁরা রাজনীতিতে এলে সমাজের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর ভালো আইন কিংবা নীতিমালা থাকলেই পরিবর্তন হবে তেমন নয়। অনেক সময় এই ধরনের নীতিমালা ও আইন মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এই সমস্যা দূর করতে হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও তৃণমূলের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে হবে।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার হলেও গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যদি শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন করা যায়, তাহলে নেতৃত্ব বিকাশের আরেকটি জায়গা সৃষ্টি হবে। এই বিষয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।
এখন খেলাঘর, কচিকাঁচার আসরের মতো সংগঠনগুলো পাড়ায় অনুষ্ঠান করতে গেলে তাদের আয়োজন পণ্ড করে দেওয়া হয়। এতে একজন ছেলের পক্ষে আর কিছুই করার থাকে না। সে তখন টিভি কিংবা ফেসবুকের সামনে বসে পড়ে। এখনই এই ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। না হলে নেতৃত্বের বিকাশ হবে না।
আমার মতে, শুধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই নেতৃত্বের জন্য বিবেচিত হবেন তা নয়। নেতৃত্ব অনেকভাবেই বিকশিত হতে পারে। এখন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা নেতৃত্বে আসছেন, এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন। আমরাও এটা চাই।
নেতৃত্বের বিকাশটা সামাজিক বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে তা বংশগতভাবেও হতে পারে। তবে পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থান তৈরি করতে পারলে নেতৃত্বের বিকাশ হবে। দেশের বিরাট অংশ যুবসমাজ। তাদের নেতৃত্ব বিকাশের পরিবেশ দিতে হবে। না হলে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। অনেক ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসতে পারে। আর শিক্ষার গুণগত মান অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।

মো. মাহাবুবুর রহমান
মো. মাহাবুবুর রহমান

মো. মাহাবুবুর রহমান: কাউন্টার পার্ট ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএসএইডের সহায়তায় তিন বছর ধরে যুব নেতৃত্বের বিকাশে কাজ হচ্ছে। ২০১৩-১৬ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার তিনটি উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ইপসা একই কাজ করে যাচ্ছে ৩০ বছর ধরে।
প্রায় তিন হাজার সামাজিক নেতা নির্বাচন করে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করছি আমরা। তাদের দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে যুব শ্রেণি ও অন্যটি বৃদ্ধ। তাদের দক্ষ করেছি। আমরা রাজনীতির জন্য এটি করিনি। প্রথমে বলেছি তুমি নিজে পরিবর্তন হও। নিজের পরিবারকে পরিবর্তন কর। পাশাপাশি তোমার আশপাশের সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে যাও। এটি ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে আমরা আমাদের কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করছি। এতে প্রশিক্ষণ পাওয়া যুব নেতারা সমাজের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তঁারা সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। সামাজিক নেতৃত্ব একটি উদাহরণ।
আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, একজন সামাজিক নেতার কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকা খুবই দরকার। অবশ্যই তাঁর মধ্যে সততা থাকতে হবে। টিমওয়ার্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি যাতে এককভাবে নেতৃত্বের কথা চিন্তা না করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কাজ করেন সে জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর নেটওয়ার্কও গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা মোকাবিলা করে যাতে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তার বৈশিষ্ট্যও থাকতে হবে সামাজিক নেতাদের।

মো. সালাহউদ্দিন
মো. সালাহউদ্দিন

মো. সালাহউদ্দিন: যখন ছাত্র ছিলাম, তখন নেতা হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করে গ্রামে চলে যাই। সেখানে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হই। এভাবে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিই এবং ২০০৩ সালে নির্বাচন করি। এখনো পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
ইউনিয়ন পরিষদগুলো চাইলেই পুরো এলাকার চেহারা পাল্টে দিতে পারে। যেমন যুব ও কমিউনিটি সংগঠনে জড়িত ব্যক্তিদের যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে সে ইউনিয়ন পরিষদটি মডেলে পরিণত হবে।
এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এখন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে তরুণদের যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে এসব বাধা দূর হবে। এ জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মানসিকতা থাকতে হবে। তাঁকে তরুণদের নেতৃত্ব গ্রহণে আন্তরিক হতে হবে। এর মাধ্যমে উন্নয়নকাজের স্বচ্ছতা আসবে। অপচয়ও বন্ধ হবে। অনেক লোকের সামনে দুর্নীতি লুকিয়ে রাখা যায় না। এভাবে যুবসমাজের শক্তি ও প্রবীণদের মেধা কাজে লাগাতে পারলে চেয়ারম্যানদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

আলেয়া বেগম
আলেয়া বেগম

আলেয়া বেগম: আমাদের গ্রামে ইপসা দীর্ঘদিন ধরে সুবিধাবঞ্চিত ও হতদরিদ্র, বিশেষ করে নারী ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে আসছে। আমিও একসময় স্বেচ্ছায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন অনেক বাধা আসে। পরে ইপসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বাধাগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। অনেক সামাজিক কাজ করতে পারছি। এখন সমাজের অবহেলিত নারী, শিশু-কিশোরদের নিয়ে ‘গুলিয়াখালী জনকেন্দ্র’ নামের একটি সংগঠন করতে পেরেছি।
লিডারশিপ ডেভেলপমেন্টের আওতায় প্রশিক্ষণ পেয়ে মনোবল বেড়েছে। সমাজের বাধাগুলো মোকাবিলা করে তা দূর করতে পারছি। পাশাপাশি নিজের জড়তা দূর হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিয়ে তৃণমূলের নারীদের সচেতন করেছি। এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত নারী সদস্যরাই আমাকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। তাঁদের অনুপ্রেরণায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি এবং জয়ী হই। পোস্টারসহ বিভিন্ন নির্বাচনী ব্যয় তাঁরাই বহন করেন।
সামাজিক নেতৃত্বের যে প্রশিক্ষণ আমি পেয়েছি, তা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি না। অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছি।

মঈনুল হোসেন
মঈনুল হোসেন

: আগে নেতৃত্বের বিষয়ে সচেতন ছিলাম না। ইপসা থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমাদের মনমানসিকতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর প্রথমে এলাকার রাস্তাঘাট সংস্কারের উদ্যোগ নিই। আমাদের এলাকাটি চরাঞ্চল। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ি চলাচল করতে পারে না। এতে রোগীসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে চলাফেরা করতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই রাস্তা সংস্কারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইউপি চেয়ারম্যান আমাদের সহযোগিতা করেন। তারপর সামাজিক চাঁদা তুলে রাস্তা সংস্কার করি।
আমাদের এলাকায় সোনালি স্বপ্ন নামের একটি সংগঠন আছে। এই সংগঠনটি চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এখান থেকে বিদ্যালয় ছিল চার কিলোমিটার দূরে। রাস্তা ভালো না। এ কারণে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল শিশুরা। তাই সংগঠনের সদস্যরা চরাঞ্চলের ৫৫ শিশুকে সপ্তাহে দুদিন সময় দিতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে তাদের অক্ষরজ্ঞান ও অন্যান্য শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের শিক্ষাসামগ্রী কিনে দেওয়া হয়। কারণ, তাদের অভিভাবকদের পক্ষে তা কেনা সম্ভব নয়। এই অভিভাবকদের মূল পেশা মাছ ধরা ও কাঠ কাটা। এ ছাড়া এই এলাকার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যাপারে সচেতন করে তুলি। একসময় অনেকে নদীর পানি পান করতে। এর বাইরে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। এসব ব্যাপারে সচেতন করার কারণে এখন বাল্যবিবাহের হার কমেছে।

মো. শাহ আলম
মো. শাহ আলম

মো. শাহ আলম: আমাদের দেশে নেতার অভাব নেই। তবে সুনেতৃত্বের অভাব রয়েছে। নেতৃত্ব আসলে অনেকভাবে সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃতিগতভাবে নেতৃত্ব আসতে পারে। পারিবারিকভাবে নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের নির্দেশনা ও পরামর্শে একজন ব্যক্তি নেতা হয়ে উঠতে পারেন। সমাজও নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। তবে আমরা এসব থেকে দূরে সরে গেছি। ফলে অনেক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
ইপসার যুব নেতৃত্ব কর্মসূচির কারণে সমাজের অনেক বিশৃঙ্খল ঘটনা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। যুব নেতৃত্ব থাকায় সীতাকুণ্ডের একটি ইউনিয়নে তিনটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। বাল্যবিবাহ একটি ব্যাধি। এর প্রতিরোধে যুব নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিরা কাজ করে যাচ্ছেন।

যাঁরা অংশ নিলেন
ওবায়দুল করিম : অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আমীর এম নসরুল্লাহ : সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

দেলোয়ার মজুমদার : সভাপতি, সচেতন
নাগরিক সমাজ

এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী : চেয়ারম্যান, সৈয়দপুর ইউনিয়ন

আনোয়ারা আলম : শিক্ষাবিদ

রেহেনা বেগম : আইনজীবী

মো. আরিফুর রহমান : প্রধান নির্বাহী, ইপসা

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর : অধ্যক্ষ, বিজয় সরণী কলেজ

মো. মাহাবুবুর রহমান : পরিচালক, ইপসা

মো. সালাহউদ্দিন : চেয়ারম্যান, ওয়াহিদপুর
ইউনিয়ন, মিরসরাই

আলেয়া বেগম : ইউপি সদস্য
মুরাদপুর ইউনিয়ন, সীতাকুণ্ড

মঈনুল হোসেন : উদ্যোক্তা, মিরসরাই

মো. শাহ আলম : যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, সীতাকুণ্ড

সঞ্চালক

বিশ্বজিৎ চৌধুরী : যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো