সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের পথ খুলছে

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে পথ উন্মুক্ত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম পাঁচ বছরে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটিকে (আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ) কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। তাই দ্রুত সাগরের সম্পদ আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় দেশের সামুদ্রিক মানচিত্র প্রণয়নের পাশাপাশি সম্পদ আহরণ ও সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও সংরক্ষণে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার ব্লু ইকোনমি (সমুদ্র অর্থনীতি) নিয়েও অগ্রসর হতে শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র, নৌপরিবহন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সামুদ্রিক সম্পদ কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আগামী ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালারও আয়োজন করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বঙ্গোপসাগরের নিজস্ব এলাকায় দেশের চূড়ান্ত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ উপকূল থেকে ৩৫৪ মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সম্পদ আহরণের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের মহীসোপান সীমানির্ধারক কমিশনে (সিএলসিএস) দাবি পেশ করেছে সরকার।
সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সমুদ্রসীমার আলোকে বাংলাদেশের সীমানায় থাকা তেল-গ্যাসসহ সব ধরনের সম্পদ আহরণে সরকারকে দ্রুত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, নিয়মানুযায়ী কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রথম পাঁচ বছরে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটিকে কোনো কিছু পরিশোধ করতে হয় না। কিন্তু পাঁচ বছরের পর থেকে আহরিত মোট সামুদ্রিক সম্পদের একটি অংশ ওই কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় এখন জাতিসংঘের সিএলসিএসে দেওয়া মহীসোপানের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলায় বাংলাদেশের অন্যতম অনুঘটক এই কর্মকর্তা জানান, গভীর সমুদ্রে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘে মহীসোপানের দাবিসংক্রান্ত অবস্থানপত্র ২০১১ সালে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থানপত্রে উপকূলীয় রেখা থেকে প্রায় ৪০০ থেকে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারত যথাক্রমে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে সিএলসিএসে তাদের দাবি উপস্থাপন করেছে।
মহাদেশগুলোর প্রসারিত পরিসীমা অঞ্চলকে মহীসোপান বলে। একটি দেশে সমুদ্রসীমার প্রথম ১২ নটিক্যাল মাইল ওই দেশের সার্বভৌম সামুদ্রিক অঞ্চল। এর পরবর্তী ২০০ নটিক্যাল মাইল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও পরবর্তী অঞ্চল হলো মহীসোপান, যা ৩০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারে। মহীসোপান এলাকায় যেকোনো দেশের জাহাজ চলাচল করতে পারে, যদিও সম্পদের অধিকার থাকে কেবল সংশ্লিষ্ট দেশেরই।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার পেয়েছে।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মহীসোপানের দাবি প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, দাবিকৃত দেশকে প্রমাণ করতে হবে, সাগরের তলদেশে যে পলি জমে, তার ন্যূনতম ১ শতাংশ ওই দেশের। এর প্রস্তুতি হিসেবে ২০১০ সালের মার্চে প্রয়োজনীয় সিসমিক ও ব্যাথিম্যাট্রিক জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। এরপর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘে মহীসোপানের দাবি পেশ করে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, মহীসোপানের দাবি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র তৈরির সময় জার্মানি, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের সহায়তা নিয়েছে সরকার। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ও কারিগরি সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে কমনওয়েলথ সচিবালয় থেকে। বাংলাদেশের চূড়ান্ত অবস্থানপত্র তৈরির পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সম্প্রতি সরকারের আমন্ত্রণে সিএলসিএসের অন্যতম অভিজ্ঞ সদস্য হেরাল্ড ব্রেকা বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি অবস্থানপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখার পর সন্তোষ প্রকাশ করেন। ব্রেকা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের জানান, বাংলাদেশের অবস্থানপত্র বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি দিক থেকে যথার্থ বলে তিনি মনে করছেন।
বাংলাদেশের দাবি নিয়ে কবে আলোচনা হতে পারে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সিএলসিএসে এখন পর্যন্ত ৫২টি দেশ তাদের অবস্থানপত্র জমা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র নিয়ে আলোচনার জন্য আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
রায় এক, প্রতিক্রিয়া বিপরীত: সরকারের ব্যর্থতায় সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলায় ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ বাংলাদেশ হারিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির নেতা সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ। তবে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত মঙ্গলবার রায় ঘোষণার জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বলেছিলেন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর জেগে ওঠা দ্বীপটিকে ১৯৮৯ সালের পর আর দেখা যায়নি। গত বছরের অক্টোবরে বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখার সময় হেগের স্থায়ী সালিসি আদালতের বিচারকেরাও দ্বীপটি শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারত তাদের কাছে নিউ মুর হিসেবে পরিচিত দ্বীপটির অস্তিত্ব তুলে ধরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে শুনানি ও রায়ে এটি স্থলভাগ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তবে সমুদ্রের যে জায়গায় দ্বীপটির অবস্থান, সে অংশটি ভারতের জলসীমায় পড়েছে।
তবে এই রায় নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ বলেছে, বাংলাদেশের কাছে ভারত বিপুল পরিমাণ সমুদ্র এলাকা হারিয়েছে। তবে ভারতের একমাত্র সান্ত্বনা হলো, তারা বহুল আলোচিত নিউ মুর বা দক্ষিণ তালপট্টি নামের ক্ষুদ্র দ্বীপটির অধিকার পেয়েছে। যদিও স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, দ্বীপটি সাম্প্রতিক সময়ে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
পত্রিকাটির গতকাল বুধবার প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের এক সালিসি আদালতের ‘যুগান্তকারী রায়ে’ পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডের চেয়ে বড় আয়তনের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের কাছে হারিয়েছে ভারত। ফলে ভারতীয় জেলেরা সাগরের ওই অংশে মাছ ধরার সুযোগ হারালেন। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রের ওই অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগও হারাল ভারত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমাবিরোধ আলোচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় কর্মকর্তা পত্রিকাটিকে বলেছেন, রায়টি ভারতের জন্য সুখকর হয়নি। তবে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।