সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দলীয় নেতা–কর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে সব ধর্মের নাগরিকদের অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
এ জন্য নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সম্প্রীতি বজায় রাখতে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি শান্তি সম্মিলন, শান্তি মিছিল ও শান্তিসভা করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের নবনির্মিত ‘অফিস ভবন’–এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কোনো ধরনের সংঘাত দেখা না দেয়। কারণ, এই মাটিতে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার ডাকে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। কাজেই এ স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, কুমিল্লার যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, সেটা খুব দুঃখজনক। কারণ, মানবধর্মকে সম্মান করাই ইসলামের শিক্ষা। নিজের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সবার রয়েছে, তেমনি অন্যের ধর্মকেও কেউ হেয় করতে পারে না। এটা ইসলাম শিক্ষা দেয় না। আর নিজের ধর্মকে সম্মান করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ধর্মকেও সম্মান করতে হয়, অন্য ধর্মকে হেয় করলে নিজের ধর্মকেই অসম্মান করা হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা সেটাই দেখব। আমাদের পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননা করেছে অন্যের ধর্মকে অসম্মান করতে গিয়ে। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক। যার যার নিজের ধর্মের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। আর একটি কথা, আইন কেউ হাতে তুলে নেবেন না। কেউ অপরাধ করলে সে যে–ই হোক, অপরাধীদের বিচার হবে। আমাদের সরকার সে বিচার করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ধর্ম নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। কাজেই সবাইকে সে কথা মেনে চলতে হবে এবং জানতে হবে, তাহলেই সঠিক শিক্ষা পাওয়া যাবে। প্রতিটি ধর্মই শান্তির বাণীর কথা বলে, সবাই শান্তি চায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজে বসবাস করি, যেখানে সকলের ধর্মের সাথে আমাদের সম্প্রীতি থাকবে এবং এই সম্প্রীতি নিয়েই আমাদের চলতে হবে। কেননা যুগ যুগ ধরেই এ দেশে সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে আসছে।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে কোনো ধর্ম দেখে নয়, যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের রক্তের সঙ্গে সব ধর্ম একাকার হয়ে মিশে গেছে। আর এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে সব ধর্মের, বর্ণের ও সব শ্রেণি–পেশার মানুষই একটা মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে চলবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই মাঝেমধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা হয় বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পরপরই পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁবু টাঙিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুকনো খাবার থেকে শুরু করে রান্না করা খাবার বিতরণ, কাপড়চোপড় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন অনুষ্ঠানে কুমিল্লা প্রান্ত থেকে স্বাগত বক্তৃতা দেন। এ সময় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কুমিল্লা প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
‘যতই সম্পদ হোক, দুঃসময়ে তা কাজে লাগে না’—এ শিক্ষা করোনা মহামারি দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষ মরে গেলে এই সম্পদ পড়ে থাকবে, তা কোনো কাজেই আসবে না। কাজেই যত বেশি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে পারা যাবে, সেটাই জাতির পিতার ও ইসলামের শিক্ষা। আর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাই হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য, সে কথাও মনে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই চলতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বেদে, তৃতীয় লিঙ্গ এমনকি কুষ্ঠরোগীদের জন্যও ঘরবাড়ি করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি যেভাবে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও মানুষকে সেভাবে দেখে তাদের সেবা করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এমন একটা সংগঠন, যা জাতির পিতা করে দিয়ে গিয়েছেন, যে সংগঠন এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের উন্নতি হয়, মানুষের কল্যাণ হয়। অথচ ’৭৫–এর পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা মানুষকে কিছু না দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। কাজেই আমরা চাই সারা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আওয়ামী লীগের একটা অফিস হোক।’
কুমিল্লা খাদ্যে উদ্বৃত্ত অঞ্চল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী নদী খনন ও জলাধার সংস্কারসহ এর অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং এটা অব্যাহত থাকবে। গ্রামগুলোতে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা যেন শহরের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পেতে পারেন, তার ব্যবস্থা সরকার করে দিচ্ছে।’
কুমিল্লাকে বিভাগে রূপান্তরিত করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফরিদপুর এবং এর আশপাশের জেলাগুলোকে নিয়ে ‘পদ্মা’ এবং কুমিল্লা ও তার আশপাশের জেলা নিয়ে ‘মেঘনা’ বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ’৭৫–এর পর সবচেয়ে বেশি নির্মম নির্যাতনের শিকার রাজনৈতিক সংগঠন হিসেব উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যেখানেই মানুষের ওপর কোনো নির্যাতন হয়, আওয়ামী লীগ পাশে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে থাকে। আর বিএনপি-জামায়াতের কাজই হচ্ছে ধ্বংস করা। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে কত মানুষ জীবন দিয়েছে, অসংখ্য নেতা-কর্মীকে তারা হত্যা করেছে, অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া আজ তৃণমূলের মানুষ পেতে শুরু করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে, তা দিয়েই আমরা দেশকে গড়ে তুলব। সেটাতেই আমরা বিশ্বাস করি। আমরা কারও কাছে হাত পেতে চলব না। কারণ, ভিক্ষুক জাতির কোনো ইজ্জত থাকে না, সে শিক্ষাও জাতির পিতাই দিয়ে গেছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃতপক্ষে দেশের যখন উন্নয়ন হচ্ছে, একটা শ্রেণি আছে, তারা কখনো এটা মানতে পারে না। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে চলবে, এটা তাদের কাছে পছন্দ নয়। আর বিএনপি-জামায়াতের কখনোই এটা পছন্দ হবে না, কারণ খালেদা জিয়ার অন্তরে সব সময়ই ছিল ‘পেয়ারে পাকিস্তান’।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন দেশ। কাজেই ভবিষ্যতে আর কেউ বাংলাদেশের ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা কখনো আর কারও অধীন হব না। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলব। সেই কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ গণমানুষের সংগঠন আর তারাই এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। তারা দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দেবে, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে। আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে আমরা মাথা উঁচু করে চলব, যেটা জাতির পিতা চেয়েছিলেন।