পুলিশের তথ্যভান্ডার
সারা দেশে ৪৪ হাজার বৈধ অস্ত্র
এসব অস্ত্র ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীও রয়েছেন।
সারা দেশে এখন বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪৪ হাজার ১০৪টি, যার মধ্যে ব্যক্তির নামে রয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্র। বাকি অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হালনাগাদ বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফএএমএস) সূত্রে বৈধ অস্ত্রের এই হিসাব পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করার জন্য এই তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়েছে।
এসবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত জুলাই থেকে দেশে ছয় শতাধিক থানা এলাকার লাইসেন্সকৃত অস্ত্র এবং এর ব্যবহারকারীদের তথ্য এই তথ্যভান্ডারে যুক্ত করা হয়। ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৪ হাজার ১০৪টি অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য এতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ব্যক্তির নামে। বাকি ৩ হাজার ৩২৭টি অস্ত্র রয়েছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। একজনের নামে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স থাকার নজিরও আছে। বিভাগভিত্তিক হিসাব ধরলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১১ হাজার ৮৯৮টি। আর সবচেয়ে কম বরিশালে, ২ হাজার ২৪৮টি অস্ত্র।
সারা দেশে লাইসেন্স করা অস্ত্র হারানো, থানায় জমা দেওয়া, লাইসেন্স করা অস্ত্রের বিষয়ে পুলিশের পরিদর্শন ও অস্ত্র খোয়া যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে ৮৪টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ী বাতিল করা হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরাও সরকারের কাছ থেকে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে বলে নানা সময়ে খবর বের হয়েছে।
গত অক্টোবরে মিরপুর ১ নম্বরে দারুসসালাম থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে পথচারীদের ভয় দেখাচ্ছিলেন। তখন মিরপুর থানার পুলিশ তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রটি জব্দ করে। গত ২৪ মার্চ দক্ষিণখানের আইনুছবাগে আমিনুল ইসলাম ওরফে জাপানি হান্নান লাইসেন্স করা শটগান দিয়ে স্থানীয় রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী আবদুর রশীদকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় আমিনুল ও তাঁর ১৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় হত্যা মামলা হয়। ওই মামলায় আমিনুলসহ আটজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা সঠিক তত্ত্বাবধান ও তদারক করলে ফাঁকফোকর আর থাকবে না। মানুষকে অস্ত্রের ভয় দেখালে লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে।নূর মোহাম্মদ সাবেক আইজিপি
আবার বৈধ অস্ত্রের দোকানের আড়ালেও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা চালাচ্ছেন কেউ কেউ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বৈধ অস্ত্রের দোকান রয়েছে মো. হোসেনের। বৈধ লাইসেন্স নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন অবৈধ অস্ত্রের কারবার। গত ৩১ অক্টোবর রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড মোড়ের কাছে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলিসহ হোসেন ও তাঁর তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে পুলিশ জানায়, তিনি চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করেন এসব অবৈধ অস্ত্র। তাঁর বৈধ অস্ত্রের ব্যবসার আড়ালে এমন অবৈধ কারবার দীর্ঘদিন অজানা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা সঠিক তত্ত্বাবধান ও তদারক করলে ফাঁকফোকর আর থাকবে না। মানুষকে অস্ত্রের ভয় দেখালে লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে।
বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে গত ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সম্প্রতি রাজধানীর মালিবাগে এসবির প্রধান কার্যালয়ে এ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো অস্ত্র উদ্ধার হলে অস্ত্রের গায়ে থাকা বারকোড বা সিরিয়াল নম্বর সফটওয়্যারে প্রবেশ করালেই জানা যাবে সেটি বৈধ, নাকি অবৈধ অস্ত্র। বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীর হালনাগাদ পরিসংখ্যানের পাশাপাশি তার অবস্থানও জানা যাবে।
এসবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দিনে কয়টি অস্ত্র-গুলি বিক্রি হয়, তা বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হয়। থানাকে না জানানো পর্যন্ত এই অস্ত্র বা গুলি কে কিনল, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানার সুযোগ নেই। তবে নতুন তথ্যভান্ডার চালু হওয়ায় অস্ত্র বা গুলি বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গেই এসব তথ্য জানা যাবে।
এফএএমএস নামের এই তথ্যভান্ডার তৈরির তত্ত্বাবধানে যুক্ত ছিলেন এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবদুস ছালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে অস্ত্রের লাইসেন্স এবং এর কার্যক্রম আগে হাতেকলমে নিবন্ধন করা হতো। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সঠিক তথ্য পাওয়া যেত না। এখন ডিজিটাল তথ্যভান্ডার চালু হওয়ায় কেউ বৈধ অস্ত্র অবৈধভাবে বিক্রি করতে গেলে ধরা পড়বে। আবার যদি কেউ অবৈধ অস্ত্রকে বৈধ বলে দাবি করে, তা–ও মুহূর্তেই যাচাই করা যাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অনেক সময় বিশেষ প্রয়োজনে সরকার সংশ্লিষ্ট থানায় বৈধ লাইসেন্সধারীদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সে ক্ষেত্রে অস্ত্র জমা পড়ার তথ্যও দ্রুত জানা যাবে।