সার্জেন্ট জহুরের শেষ প্রহর

শহীদ জহুরের মৃতদেহে পাশে বাবা কাজী মজিবুল হক, দুই ভাই মাহবুবল হক ও আমিনুল হক
ছবি: সংগৃহীত

ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। ’৬৯–এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। তেমন করে আলো ফোটেনি, চারদিকে হালকা আলো কমলা রঙের আভা ছড়াচ্ছে। পাখিরা জেগে ওঠে আরও আগে—তাদের কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে। জহুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজলুল হকের পেটে ব্যথা হচ্ছে। তাঁর ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। জহুরকে তিনি ডাকলেন, জহুর আগে থেকেই জেগে ছিলেন। গত রাতে তাঁর ভালো ঘুম হয়নি। কেমন আচ্ছন্নের মতো রাতটা কেটে গেছে। চাপা একটা ক্রোধ তাঁর বুকের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। অনেক দিন ধরে তাঁরা এই থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ব্যারাকে বন্দী অবস্থায় আছেন।

ফজলুল হক বললেন, ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিবিধি দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। জহুর বললেন, ‘চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’ রুমে ছিলেন স্টুয়ার্ড মুজিব, উনিও উঠে দাঁড়ালেন। ‘চলো, আমরা একসঙ্গে যাই। গত রাতের ঘটনাটায় ওরা খেপে আছে, তবু আমাদের হয়তো কিছু করবে না।’

জহুরের মনে ভেসে উঠল গত রাতের পাকিস্তানি সেনাদের দুর্ব্যবহার। ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় যেসব রাজবন্দী ছিলেন, তাঁদের জন্য পাকিস্তানিরা মানসম্পন্ন খাওয়াদাওয়া দিত না। বাঙালিরা ভাত খেতে পছন্দ করে জেনেও তারা অভিযুক্তদের নিম্নমানের মোটা চালের ভাত দিত, এমনকি সেই ভাতের সঙ্গে কাঁকর মেশানো থাকত। থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যে ব্যারাকে আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা বন্দী অবস্থায় ছিলেন, সেটি ষাট দশকে নির্মিত একটি একতলা দালান, কোথাও কোথাও টিনের ছাদ, তার পাশেই ছিল কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে মাঝেমধ্যেই কিছু গরিব ছোট ছোট অভুক্ত শিশু সামান্য খাবারের আশায় আসত। মূলত তারা অভিযুক্তদের অবশিষ্ট খাবারগুলো সংগ্রহ করতে আসত। গত রাতে জহুর চুপচাপ বসে ছিলেন। অন্য অভিযুক্তরা তাঁদের অবশিষ্ট খাবার অসহায় শিশুদের মধ্যে বিতরণ করে দিচ্ছিলেন। এভাবে প্রায়ই অভিযুক্তরা তাঁদের খাবার থেকে একটা অংশ কাঁটাতারের বেড়ার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত ছোট বাচ্চাদের দিয়ে দিতেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রায় প্রতিদিনই এই ছোট বাচ্চাদের গালাগাল আর মারধর করে তাড়িয়ে দিত। গত রাতেও অভিযুক্তরা একইভাবে খাবার বিলিয়ে দিচ্ছিলেন।

পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ আবারও গালাগাল শুরু করেন। একপর্যায়ে অভিযুক্তরা প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমরা তো আমাদের খাবার থেকে খাবার বাঁচিয়ে ওদের দিচ্ছি।’

মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের লাথি মারা শুরু করেন। জহুর চুপচাপ বসে পুরো ঘটনাটা দেখছিলেন। মঞ্জুর শাহর দুর্ব্যবহার দেখতে দেখতে হঠাৎ তাঁর বুকের ভেতর এক তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। জহুর মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ান এবং অতর্কিতে মঞ্জুর শাহর ওপর ঝাঁপ দিয়ে তাঁর রাইফেলটা কেড়ে নেন। মঞ্জুর শাহ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

জহুর বলে ওঠেন, ‘তোমরা কী ভেবেছ? তোমাদের এই দুর্ব্যবহার দেখে দেখে আমরা অসহ্য হয়ে পড়েছি, তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে তাই এত ক্ষমতা দেখাচ্ছ। চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি।’ এই কথা বলার পর, জহুর সবলে রাইফেলটি মঞ্জুর শাহর দিকে ছুড়ে দেন। মঞ্জুর শাহর চেহারা দেখে অন্য অভিযুক্তরা বুঝতে পারেন—অস্ত্রধারী এই উদ্ধত পাকিস্তানি সেনাটি তার যোগ্য অপমানটি পেয়েছে। মঞ্জুর শাহ হতবাক হয়ে পড়লেন, তিনি ভাবতেও পারেননি, একজন নিরস্ত্র বাঙালি অভিযুক্ত এইভাবে প্রতিবাদ করতে পারেন! আবার এইভাবে রাইফেলটা ছুড়ে দিতে পারেন!

বন্দীদের কক্ষগুলো বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকত। ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে শব্দ করায় সেন্ট্রি এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তোম লোক কেয়্যা চ্যাতা?’

তাঁরা ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বললেন। সেন্ট্রি বলল, একটু অপেক্ষা করতে হবে ওপর থেকে পারমিশন আনতে হবে। তারপর নিয়ে যাওয়া যাবে। কিছুক্ষণ পর সেন্ট্রি এসে গেট খুলে কড়া গলায় তিনজনকে লাইন করে দাঁড়াতে বলল। কক্ষগুলোর সামনে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। সেখান থেকে হেঁটে গিয়ে শেষ মাথায় ছিল ওয়াশরুম।

ভোরের আভা মাত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে—জহুর সবার আগে হাঁটছেন, মাঝখানে ফজলুল হক, শেষে স্টুয়ার্ড মুজিব। ওয়াশরুমের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁরা এক অশনিসংকেত বুঝতে পারলেন। দ্রুত বুটের শব্দে কেউ এগিয়ে আসছে। জহুর বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি সোজা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গত রাতের সেই উদ্ধত পাকিস্তানি সৈনিক মঞ্জুর শাহ রাইফেল তাক করে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে–মুখে রক্তের পিপাসা, আক্রোশের ছাপ।

উর্দুতে গালি দিয়ে বললেন—‘কাল তোর সাহস দেখেছি, কিন্তু আজ আমি তোদের মেরে ফেলব।’ জহুর একটুও বিচলিত হলেন না। সরাসরি তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। মঞ্জুর শাহ মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালালেন, গুলি এসে সোজাসুজি জহুরের পেটে লাগল। আচমকা গুলির আঘাতে দীর্ঘদেহী মানুষটি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আরও একটি গুলির শব্দ, ফজলুল হকের দেহটিও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

জহুর ফজলুল হককে ডাকলেন। বললেন, ‘ফজলু শক্ত হও, গত রাতের সেই বর্বর পাকসেনারা আমাদের মেরে ফেলতে চাচ্ছে, আমাদের উঠতে হবে, বাঁচতে হবে।’

ওদের বর্বরতা যে কতখানি নির্মম হতে পারে, তারই দৃশ্য এবার ফুটে উঠল। পাকসেনারা ছুটে এসে হাসতে হাসতে বলল, ‘দ্যাখো, ইয়ে আদমি আভি তাক জিন্দা হ্যায়।’

রাইফেল খাড়া করে জহুরের গুলিবিদ্ধ পেটের ওপর উঠে দাঁড়াল। রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে সরাসরি পেটের মধ্যে আঘাত শুরু করল। বেয়নেটের আঘাতে জহুরের পেটের সমস্ত তন্ত্রী ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যটি ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুটের আঘাতে জহুরের কলার বোন ভেঙে গেল। জহুর বুঝে উঠতে পারছেন না একজন নিরস্ত্র মানুষকে একজন অস্ত্রধারী মানুষ কীভাবে এ রকম নৃশংস আক্রমণ করতে পারে। আজন্ম এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন—একজন প্রকৃত যোদ্ধা নিরস্ত্র মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। পাকিস্তানি বর্বর মঞ্জুর শাহর বেয়নেটের আঘাতে জহুরুল ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

গুলির শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কারাগার কক্ষে বন্দী বাকি অভিযুক্তদের। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন, কোথায় গুলি চলছে। কারাগার কক্ষে নিচের দিকে জানালা ছিল না। তাই সরাসরি তাঁরা দেখতে পারছিলেন না। দেয়ালের ওপরের দিকে লোহার গ্রিল ও কাচের শার্সি ছিল। অভিযুক্তরা চেয়ার টেনে এনে তার ওপর দাঁড়িয়ে ওপরের জানালা দিয়ে কষ্ট করে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অভিযুক্তরা অচিরেই বুঝতে পারলেন তাঁদের কোনো ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধার ওপর বর্বর পাকসেনারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না। বাইরে থেকে সব কটি কক্ষ তালাবদ্ধ। বাইরে পাকিস্তানি সেনারা জোরেশোরে টহল দিচ্ছে। কিন্তু বাঙালিরা থেমে থাকতে পারছিল না। তারা ঘরের ভেতর থেকে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে, চিৎকার করে প্রতিবাদ শুরু করে দিল। তাদের প্রতিবাদে চিৎকারে সমস্ত পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। জহুরের কখন জ্ঞান হারিয়েছিল আবার কখন জ্ঞান এল, তিনি কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারছেন না। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন—একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে আর ফজলুল হককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

জহুর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কেমন লাগছে? সাহস রাখো, আমরা বেঁচে যাব।’

ফজলুল হক জহুরকে বললেন, ‘তোমার জখম অনেক বেশি, তোমার কেমন লাগছে। আমাদের ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী করবে বুঝতে পারছি না!’ (সংক্ষেিপত)

নাজনীন হক মিমি: শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ভ্রাতুষ্পুত্রী।

’৬৯–এর শহীদ সার্জন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ (জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা, ২০২০) গ্রন্থ থেকে।