সাড়ে চার লাখ মানুষ আক্রান্ত তিন মাসে

  • ওয়াসার পানিতে ক্লোরিন বাড়ানোর পরামর্শ।

  • পানি ফুটিয়ে খেতে হবে, রাস্তার পাশের উন্মুক্ত খাবার যাওয়া যাবে না।

  • ফিডারে শিশুকে কিছুই খাওয়ানো যাবে না। শিশু অবশ্যই মায়ের দুধ খাবে।

ছোট্ট মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে শঙ্কায় মা। শনিবার রাত থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মেয়েটি। অবস্থার অবনতি হলে গতকাল সকালেই রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে মহাখালীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে তাকে নিয়ে আসে পরিবার। গতকাল দুপুরে
ছবি: জাহিদুল করিম

বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মহাখালী হাসপাতাল। এই হিসাব সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের। আইসিডিডিআরবি বলেছে, এখন তাদের হাসপাতালে আসা রোগীদের ২৩ শতাংশ তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত।

আইসিডিডিআরবি ও সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, বাংলাদেশে সারা বছর কমবেশি ডায়রিয়ার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই সময় ডায়রিয়া বেশি ছড়িয়ে পড়েছে বলে তারা মনে করছে। গতকাল রোববার স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়রিয়ার প্রকোপ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। এটি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সারা দেশে ডায়রিয়া রোগীর জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসের হিসাব দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া মোট রোগী ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন। এর মধ্যে মারা গেছে দুজন।

‘ডায়রিয়ার প্রকোপ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। এটি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
নাজমুল ইসলাম, অধ্যাপক

ডায়রিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে। আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৪১৫ জন। আট বিভাগের হিসাবে দেখা যায়, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে ডায়রিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চ মাসে কমেছে। অন্য সব বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা স্বাস্থ্য বিভাগের এই হিসাবের চেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু সরকারি হাসপাতাল ও আইসিডিডিআরবির মহাখালী হাসপাতালের তথ্য দেয়। অনেক রোগী চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নেয়। এ ছাড়া সাধারণ ডায়রিয়ায় অনেকে নিজে স্যালাইন কিনে খায়।

সারা দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ।

আইসিডিডিআরবির চিত্র

১৬ মার্চ থেকে আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকাল প্রথম ১১ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে ৪০২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল।

বেলা সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় রোগী, রোগীর আত্মীয়, চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, নিরাপত্তারক্ষীদের ভিড়। একের পর এক রোগী আসছে। কোনো কোনো সময় একসঙ্গে চার–পাঁচজন রোগী আসতে দেখা গেল। সব বয়সী রোগী। কয়েকজন রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেল, রোগীর নিবন্ধন ও ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করার অপেক্ষায় না থেকে তাদের শয্যায় তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হচ্ছে, শিরায় স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। এসব রোগীর অবস্থা খারাপ।

দুপুর ১২টা নাগাদ ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮৮। অর্থাৎ এক ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হয়েছিল ৮৬ জন।

রোগী যেমন আসছে, তেমনি অনেক রোগীকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেও দেখা গেল। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভর্তির পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগীকে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। এই হাসপাতালের সব রোগীর চিকিৎসা বিনা মূল্যে হচ্ছে।

ওই দুই জেলা ছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু স্থানের পানি পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল খুব শিগগির রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
তাহমিনা শিরীন, অধ্যাপক

পানি পরীক্ষার উদ্যোগ

দুপুর ১২টার আগে হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মার্চের শুরু থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো হয়।

আইসিডিডিআরবি ঢাকার পানি পরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তাহমিদ আহমেদ বলেন, পানির বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। পানিতে ক্লোরিনের পরিমাণ বাড়াতে ওয়াসাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে

ডায়রিয়া ও কলেরা পানিবাহিত রোগ। ক্লোরিন পানিতে থাকা জীবাণু মেরে ফেলে।

ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ জানতে নরসিংদী ও বরগুনায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দুটি দল পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুই জেলা ছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু স্থানের পানি পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল খুব শিগগির রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

ডায়রিয়াজনিত রোগ হয় ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে। এর মধ্যে রোটা ভাইরাসের কারণে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া তিন ধরনের ব্যাকটেরিয়ায় ডায়রিয়াজনিত রোগ হয়।
এ এস এম আলমগীর,বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

কলেরার রোগী ২৩ শতাংশ

আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে মার্চ মাসে ২৯ হাজার ৬৮১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। এদের ২৩ শতাংশ বা ৬ হাজার ৮২৬ জন ছিল তীব্র ডায়রিয়ার রোগী।

আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন ধরনের রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে। কিছু রোগীর শরীরে তীব্র পানিশূন্যতা দেখা যাচ্ছে। কিছু রোগীর পানিশূন্যতা আংশিক। কিছু রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেও পানিশূন্যতা দেখা যাচ্ছে না।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ডায়রিয়াজনিত রোগ হয় ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে। এর মধ্যে রোটা ভাইরাসের কারণে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া তিন ধরনের ব্যাকটেরিয়ায় ডায়রিয়াজনিত রোগ হয়। ভিবরিও কলেরি নামের ব্যাকটেরিয়া কলেরা বা তীব্র ডায়রিয়ার কারণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলেরার রোগীর শরীর থেকে দ্রুত পানি বের হয়ে যায়। চোখ গর্তে চলা যায়। জিহ্বা শুকিয়ে যায়। রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা চলে যায়। অর্থাৎ চিমটি দিলে ত্বক কুঁচকে থাকে, অল্প সময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে না। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। পানিশূন্যতার কারণে এসব রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি আছে।

কী করণীয়

এ বছর ডায়রিয়ায় দেশে দুজন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। একজন লক্ষ্মীপুরে, অন্যজন কক্সবাজার জেলায়। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। ডায়রিয়া হলেই মানুষ নিজে উদ্যোগে খাওয়ার স্যালাইন কিনে খায় অথবা খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করে খায় অথবা হাসপাতালে যায়। এসব কারণে ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যু কমেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগ কী করছে—জানতে চাইলে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকদের ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া চিকিৎসার ওষুধ, স্যালাইন মজুত করা হচ্ছে। সারা দেশের পরিস্থিতির ওপর স্বাস্থ্য বিভাগ নজর রাখছে।

আইসিডিডিআরবি বলছে, মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ডায়রিয়া থেকে দূরে থাকতে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে, রাস্তার পাশের উন্মুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না, খাওয়ার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, ফিডারে শিশুকে কিছুই খাওয়ানো যাবে না। আর ডায়রিয়া হলে এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে, রোগীকে স্যালাইনের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে হবে, রোগীকে কোমল পানীয় বা ফলের রস বা আঙুর–বেদানা খাওয়ানো যাবে না।

শিশুর ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন তত চা–চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিক সেই পরিমাণ খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শিশু বমি করলে ধীরে ধীরে খাওয়াতে হবে, যেমন ৩ বা ৪ মিনিট পরপর এক চামচ করে খেতে দিতে হবে। খাওয়ার স্যালাইনের পাশাপাশি দুই বছরের কম বয়সী শিশু অবশ্যই মায়ের দুধ খাবে।