সিআরপি অনেকের জীবনে আশীর্বাদ

দেশে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা হলেও পুনর্বাসন সব সময় হয় না। সিআরপি দুটি কাজই করে চলেছে বছরের পর বছর।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়া মানুষের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আলোচনা উঠলেই সিআরপির নামটি চলে আসে। প্রতিষ্ঠানটির পুরো নাম সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। এটি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে, মানুষকে পুনর্বাসিত করছে। পাশাপাশি এই চিকিৎসাসেবার বিকাশে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে সিআরপিতে। স্বাস্থ্য, সেবা ও শিক্ষার এমন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কম।

সিআরপি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আট বছর পর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। তবে এর প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর সেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতার আগে থেকেই। শুরু থেকেই সিআরপি পক্ষাঘাতে বা দুর্ঘটনায় আশা হারানো হাজার হাজার মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে, পুনর্বাসিত করে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। অনেকের জীবনে সিআরপি এসেছে আশীর্বাদ হয়ে।

সাভারে সিআরপির মূল ভবনে ঢোকার মুখেই লেখা, ‘কষ্টভোগীর প্রতি সেবা সৃষ্টিকর্তারই সেবা’। প্রতিবন্ধী যেকোনো মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা পায়। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা প্রথম আলোকে বলেছেন, ছয়টি মূল্যবোধ ধারণ করে সিআরপি গড়ে উঠেছে—সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সম্মান, পরিচ্ছন্নতা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নিরন্তর প্রচেষ্টা।

১৯৭৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিত্যক্ত দুটি গুদামঘরে সিআরপির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে সাভারে ১১ একর জমিতে হাসপাতালসহ সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সিআরপি। এখানেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর ও আশুলিয়া, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, পাবনা, মৌলভীবাজার (২টি), মানিকগঞ্জ ও ময়মনসিংহে সিআরপির শাখা রয়েছে। এর কর্মীর সংখ্যা ১ হাজার ২০০–এর বেশি। গত বছর ৭২ হাজার মানুষকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সিআরপির বিষয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট অর্থোপেডিক সার্জন অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিআরপিতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ আন্তর্জাতিক মানের সেবা পায়। ফিজিওথেরাপির মতো বেশ কিছু সেবায় তারা দেশের সেরা। এসব বিষয়ে মানসম্পন্ন জনবল গড়ে তোলার কাজেও তারা যুক্ত। স্বাস্থ্য খাতে দেশে এমন প্রতিষ্ঠান কমই আছে।

ভ্যালেরি, সিআরপি ও ইতিহাস

সিআরপির কথা উঠলেই সবকিছু ছাড়িয়ে ভ্যালেরি অ্যান টেইলরের নাম সামনে চলে আসে। যুক্তরাজ্যের নাগরিক ভ্যালেরি ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এসে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার মিশনারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে যোগ দেন। ওই হাসপাতালে কাজ করার সময় ভ্যালেরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা মেরুরজ্জুতে আঘাত পাওয়া রোগীদের চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা দেখতে পান এবং স্বপ্ন দেখেন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার।

১৯৭৫ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মেরুরজ্জুতে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য ‘রিট্রেনিং অ্যান্ড জব রিপ্লেসমেন্ট প্রজেক্ট’ শুরু হয়। তখন হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন আর জে গার্স্ট। ভ্যালেরি ওই প্রকল্পের আওতায় হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। সেখানেই গড়ে তোলেন সিআরপি।

ভ্যালেরি অ্যান টেইলর
চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের জীবনমান বাড়াতে হবে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে জীবনদায়ী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে চাই। এ জন্য সিআরপির আঞ্চলিক শাখা খোলার কথা ভাবা হচ্ছে।
ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, প্রতিষ্ঠাতা, সিআরপি

কী সেবা আছে

ভারী বোঝা মাথায় নিলে, গাছ থেকে পড়ে গেলে, বড় কোনো ধাক্কায় বা অন্য আরও কোনো কারণে মানুষ মেরুরজ্জুতে আঘাত পায়। সারা দেশ থেকে এই সমস্যা নিয়ে রোগীরা যায় সিআরপিতে। এই ধরনের রোগীদের ফিজিওথেরাপি দেওয়ার ক্ষেত্রে সিআরপির বিশেষ সুনাম আছে। গত বছর হাসপাতালে ভর্তি করে ও বহির্বিভাগে প্রায় ২০ হাজার রোগীকে সেবা দিয়েছে তারা।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা আঘাত পেয়ে কর্মক্ষমতা হারানো মানুষকে দেওয়া হয় অকুপেশনাল থেরাপি। বছরে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ এই চিকিৎসা পায়। সিআরপির স্বাস্থ্যকর্মীরা স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপির মাধ্যমে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ভাব বিনিময় এবং খাবার চিবানো ও গিলে ফেলার সমস্যা সমাধান করেন। এই বিভাগে সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, স্ট্রোক, মাথায় আঘাত পাওয়া, তোতলামি এবং কণ্ঠস্বর সমস্যায় চিকিৎসা দেওয়া হয়।

কোনো ব্যক্তির অঙ্গহানি হলে বা কোনো অঙ্গে দুর্বলতা থাকলে তাদের সহায়ক সামগ্রী দিয়ে পুনর্বাসিত করে সিআরপির প্রস্থেটিকস ও অর্থোটিকস শাখা। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি উপাদানে তৈরি কৃত্রিম অঙ্গ খুব কম খরচেই পায় দরিদ্র মানুষেরা।

আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বিশেষায়িত চিকিৎসা ও সেবায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার জন্য সিআরপি প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধিভুক্ত। সিআরপির রয়েছে নিজস্ব নার্সিং কলেজ। শিশুদের একটি একীভূত স্কুলও রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং অন্য শিশুরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে। অন্যদিকে মাধব স্মৃতি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে প্রতিবন্ধী মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

দেশি-বিদেশি অনুদান ও রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থে সিআরপি চলে। তবে নিজস্ব আয়মূলক কর্মকাণ্ডও আছে।

ভ্যালেরি অ্যান টেইলর প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের জীবনমান বাড়াতে হবে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষকে জীবনদায়ী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে চাই। এ জন্য সিআরপির আঞ্চলিক শাখা খোলার কথা ভাবা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, অনেক মানুষ সিআরপির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটা আশার কথা।