সিলেট সিটিতে জামায়াতের ভোট আসলে কত?

>
  • বিএনপি নেতাদের ধারণা, শহরে জামায়াতের ভোট ১৫ হাজারের বেশি হবে না।
  •  অনেকের ধারণা, ২০ থেকে ২৫ হাজার ভোট রয়েছে।

বিএনপির বিদ্রোহী মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পর সিলেটে এখন আলোচনা চলছে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত জামায়াত নির্বাচনে থাকবে কি না, থাকলে কত ভোট পেতে পারে—এটিই এখন শহরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের আলোচনার অন্যতম বিষয়।

তবে সিলেট জামায়াতের ভোট আসলে কত, এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে সিলেট-১ আসন (সিলেট সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা মিলে তখন এই আসন ছিল) থেকে নির্বাচন করেছিলেন মহানগর জামায়াতের তৎকালীন আমির শফিকুর রহমান। তিনি প্রথমবার ১৬ হাজার ও পরেরবার ১৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।

গত এক সপ্তাহে ঢাকা ও সিলেটে জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। জামায়াত নেতাদের মূল্যায়ন হলো নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলে তাঁদের প্রার্থী ৫০ হাজারের বেশি ভোট পাবেন। আর বিএনপির নেতাদের ধারণা, জামায়াত যা-ই বলুক, দলটির ভোট ১৫ হাজার ছাড়াবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা, সিলেট শহরে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার ভোট রয়েছে জামায়াতের।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সিলেট শহরের পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, দরগাহ মহল্লা, সোবহানীঘাট, মীরাবাজারসহ কিছু এলাকায় জামায়াতের প্রভাব রয়েছে। তবে দলটির বড় ভোটব্যাংক নেই। তবে গত সিটি নির্বাচনে জামায়াতের চারজন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে জয়ী হন। এ অবস্থায় জামায়াত বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর ভোটে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না।

দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে এই প্রথম সিলেটে মেয়র পদে নির্বাচন করছে জামায়াত। নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন ও প্রতীক না থাকায় সিলেট জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের স্বতন্ত্র (টেবিল ঘড়ি প্রতীক) নির্বাচন করছেন। তিনি মহানগর জামায়াতের আমির।

মেয়র পদের পাশাপাশি সিলেটে ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের ১৩টিতে (এর মধ্যে গতবার বিজয়ী চার কাউন্সিলরও আছেন) এবং সংরক্ষিত নয়টি নারী কাউন্সিলর পদের মধ্যে দুটিতে জামায়াতের প্রার্থী রয়েছে।

কত ভোট পেতে পারেন, এই প্রশ্নে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব কোনো সংখ্যা উল্লেখ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, ইনশাআল্লাহ ৩০ জুলাই রাতেই দেখতে পাবেন কার ভোট কত।’

বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের ভোটের দিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের দৃষ্টি রয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বিএনপি ও জামায়াতের ভোট নিয়ে নানা অঙ্ক কষছেন। কারণ, জামায়াত ভালো ভোট পেলে তা বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হকের জন্য ঝুঁকি বাড়বে। এতে সুবিধা হবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের। এ ছাড়া সিলেটে জামায়াতের সঙ্গে কামরানের সুসম্পর্ক রয়েছে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন প্রচার রয়েছে।

গত সিটি নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। তখন জামায়াতের প্রার্থী ছিল না। এবার জামায়াতের প্রার্থী যদি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পান, তা বিএনপির প্রার্থীর জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই মনে করছেন।

এ বিষয়ে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত তার আদর্শ নিয়ে চলে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের কথা যারা বলে, এটি তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ।

উল্টো কামরান প্রশ্ন তোলেন, দল ও জোটের ওপর যাঁর (আরিফুল হক) নিয়ন্ত্রণ নেই, যিনি নিজের জোটে প্রশ্নবিদ্ধ, তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণ কী করবেন?

 জামায়াত মরিয়া

কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় সিলেট সিটি নির্বাচনে একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন জামায়াতের স্থানীয় নেতারা। গত বুধবার রাতে এ নিয়ে সিলেটে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। জামায়াত সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে সিলেটের নির্বাচন জামায়াতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে সব পর্যায়ে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদেরও সর্বাত্মকভাবে প্রচার চালাতে বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আশপাশের জেলা থেকেও কর্মী-সমর্থকদের সিলেটে আনা হয়েছে। দলের নারী কর্মীরা বাসাবাড়িতে গিয়ে মেয়র প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে শুরু করেছেন।

 কেন বিএনপি-জামায়াত দূরত্ব

সিলেট থেকেই একসময় বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য গঠিত হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে চারদলীয় জোটে রূপ নেয়। কিন্তু সিলেটেই এখন আর দুই দলের মধ্যে সে সম্পর্ক নেই। বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাধিক ঘটনায় আরিফুল হক চৌধুরী ও জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আরিফুল হক সিলেটের উন্নয়নে সব দলকে নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান করেন। সেখানে জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এরপর মেয়রকে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়, সেই অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘শিবির হটাও, ছাত্রদল বাঁচাও’। দুটি ঘটনায় জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়।

এ বিষয়ে আরিফুল হক চৌধুরী কারও নাম উল্লেখ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের মুখ আর অন্তরে মিল নেই, আমি তাদের পছন্দ করি না।’

বিএনপি সূত্র জানায়, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার সামনের সড়কে আরিফুলের উদ্যোগে গণশৌচাগার নির্মাণ এবং জামায়াত নেতাদের হাসপাতাল উইমেন্স মেডিকেল কলেজের দখলে থাকা দেয়াল ভেঙে রাস্তা প্রশস্ত করা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হয়। বিএনপির একজন নেতা বলেন, উন্নয়ন কমিটির বৈঠকে জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে সরকারি মহল থেকেই নিষেধ ছিল। এটি উপেক্ষা করার উপায় ছিল না মেয়রের। আর গণশৌচাগার ও রাস্তা বড় করার বিষয়ে জনস্বার্থ ছিল।

বিএনপির নেতাদের দাবি, উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার কারণে আরিফুল হক ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার দিক থেকে এতটাই এগিয়ে আছেন যে তাঁর জন্য জামায়াত বা অন্য কোনো ইসলামি দল ব্যাপার হবে না। তা ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে আরিফুল হকের বৈরিতা নতুন কোনো বিষয় নয়।

এ বিষয়ে সিলেটের সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করা আরিফুল হকের জন্য অস্বস্তিকর, এটাই স্বাভাবিক। তবে জামায়াতের যিনি প্রার্থী, তাঁর প্রতীক দাঁড়িপাল্লা থাকছে না। ফলে প্রতীকের আকর্ষণ দিয়ে যে ভোট আনা যেত, সেটা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এ ছাড়া সিলেটে জামায়াতের নেতাদের বড় বড় যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে একটি দলের বেশি অংশীদারি আছে। সেই স্বার্থেও ওরা (জামায়াত) হয়তো কাউকে হারানোর জন্য দাঁড়াতে পারে, এমন অভিযোগের কথাও শোনা যাচ্ছে।