সিয়ামের মাথা এখন মরিয়মের ব্যথা

শ্যামলী পদচারী-সেতুর ওপর ছেলেকে নিয়ে মা মরিয়ম। ছবি: প্রথম আলো
শ্যামলী পদচারী-সেতুর ওপর ছেলেকে নিয়ে মা মরিয়ম। ছবি: প্রথম আলো

মোছা. মরিয়ম। জাতীয় পরিচয়পত্র বলছে তাঁর বয়স এখন ৪৩ বছর। কুষ্টিয়ার এই নারী বর্তমানে ঢাকার শ্যামলী মনসুরাবাদে বাস করছেন। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাঁর সময় কাটে শ্যামলী পদচারী-সেতুর ওপর, ছেলের চিকিৎসা জন্য মানুষের কাছে অর্থ সহায়তা চেয়ে। তাঁর ছোট ছেলেটা হাইড্রোকেফালাসে আক্রান্ত।

সিয়াম। মরিয়মের ছয় মাস বয়সী সন্তান। সিয়ামের জন্মের ঠিক তারিখ এই মুহূর্তে মরিয়মের মনে না থাকলেও চিকিৎসাপত্র বলছে, তার জন্ম ৩ আগস্ট ২০১৭। সিয়ামের জন্ম হয় সিজারের মাধ্যমে। কারণ একটাই, তার মাথাটা অনেক বড়। মাথার ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির কারণেই চিকিৎসক সিয়ামকে মাত্র সাত মাস বয়সেই সিজার করে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তথ্য সংগ্রহের সময় ওজন করে দেখা যায়, সিয়ামের দেহের ওজন প্রায় সাত কেজি। কিন্তু পুরোটা তার দেহের ওজন নয়। শুধু মাথার ওজনই ন্যূনতম পাঁচ কেজি হবে। হঠাৎ দেখলে কেবল মাথাটাই চোখে পড়ে, শরীরটা বোঝা যায় না।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইড্রোকেফালাস হলো এমন একধরনের রোগ, যার ফলে মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বড় হয়। এটি বিরল কোনো রোগ নয়। ডাক্তাররা বলছেন, এমন রোগী প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের মাঝে এ রোগ বেশি দেখা যায়। মূলত মাথার ভেতর রক্তপ্রবাহ ছাড়াও গহ্বর (ভেন্ট্রিকল) থেকে নিঃসৃত রস (সিএসএফ) যদি বেশি বের হয় বা এই রস যদি সঠিকভাবে আত্তীকরণ (অ্যাবসর্বশন) না হয়, তাহলে এ রোগ হয়। সিএসএফ জমে জমে মাথার ভেতরের গহ্বরের আকার বড় করে দেয়। এতে বাইরে থেকে মাথা বড় দেখায়। এ ছাড়া মাথার ভেতরে টিউমারের কারণে এ রোগ হতে পারে।

সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সিয়ামের মাথার পরিমাপ করা হয়। তাতে তার মাথার পরিধি ৭৯ সেন্টিমিটার বা প্রায় ২৮ ইঞ্চি দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে সিয়ামের মাথার পরিমাপ কিশোরদের গড়পড়তা কোমরের সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। মাথার এই বৃহদাকৃতির কারণে সিয়াম ঘুমালেও বোঝা যায় না যে সে ঘুমিয়েছে। কারণ, মাথার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের ওপরের পাতাও মিলিয়ে যাচ্ছে কপালের সঙ্গে।

মরিয়মের ভাষ্য, গর্ভের দুই মাস বয়সে সিয়ামের বাবা সহিফুল শেখ গা-ঢাকা দেন। এরপর থেকে আর তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সহিফুল মরিয়মের দ্বিতীয় স্বামী। সাড়ে তিন বছর আগে তাঁর প্রথম স্বামী আকমল মারা যান। সে ঘরে তাঁর ১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। কুষ্টিয়ায় সে নানা-নানির কাছেই থাকছে। সহিফুলেরও প্রথম পক্ষের স্ত্রী রয়েছে। মরিয়মের ভাষ্য, প্রথম স্ত্রীর সন্তান হচ্ছে না—এমন কথা বলেই তাঁকে বিয়ে করেন সহিফুল। কিন্তু এখন শুনছেন, তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তান রয়েছে। মরিয়ম বলেন, সহিফুল পেশায় একজন টাইলস মিস্ত্রি।

সিয়ামের জন্ম হয় মাদারীপুর সদর হাসপাতালে। সেখানে তাঁর খালার বাসা। মাদারীপুর সদর হাসপাতালে সিয়ামকে মোট ২১ দিন রাখা হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা সিয়ামকে ঢাকার নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানোর কথা বলেন। কিন্তু যে নারী কখনো ঢাকাতেই আসেননি, তাঁর জন্য অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসা ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য কাজ। এক প্রতিবেশীর সহযোগীয় মাস খানেক পরে সিয়ামকে ঢাকায় আনা হয়।

মরিয়মের কাছ থেকে প্রাপ্ত নথি বলছে, সিয়ামকে গত ১ অক্টোবর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে দেখানো হয়। সেখানে তার সিটিস্ক্যান করা হয়। মরিয়ম বলেন, ‘অন্য রোগী ভর্তি থাকায় সেখানকার ডাক্তার সিয়ামের অস্ত্রোপচার করতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগবে বলেছেন। পরে আমি ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাই।’

গত বছরের ১৪ নভেম্বর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিয়ামের মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর সিয়ামকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু মরিয়মের ভাষ্য, অস্ত্রোপচারের পর থেকে তাঁর ছেলের মাথা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে।

মরিয়ম বর্তমানে ঢাকার শ্যামলীর পদচারী-সেতুতে তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য তুলছেন। পদচারী-সেতুর ধুলোমাখা পরিবেশে কয়েক টুকরো ছেঁড়া কম্বলের ওপর রাখা হয় শিশুটিকে। মরিয়ম বলেন, ‘আমার বাবুর খাওয়াদাওয়া, প্রস্রাব-পায়খানা সব ঠিক আছে। ও ক্ষুধা লাগলে কান্না করে।’

মরিয়ম বলেন, তিনি প্রতিদিন ৫০০ টাকা পর্যন্ত অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকেন। এতে তাঁর বাসা ভাড়া, তিন বেলা খাবার ও সিয়ামের ওষুধের খরচেই প্রতিদিন শেষ হয়ে যায়। ফলে তিনি ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য কোনো টাকা জমাতে পারছেন না। সর্বশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সিয়ামকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারে এক লাখ টাকার পাশাপাশি সিট ভাড়া, ওষুধসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হবে বলে মরিয়মকে জানিয়ে দিয়েছেন।

মরিয়মের ভাষ্য, একসঙ্গে এত টাকা তাঁর পরিবারের নেই। এ পর্যন্ত তিন লাখ টাকার মতো খরচ করেছেন। সমাজের কেউ যদি একটু এগিয়ে আসত, তাহলে তাঁকে আর রাস্তায় থাকতে হতো না। বাড়িতে বড় ছেলেটি কান্নাকাটি করছে। তাঁর বাবা-মাও প্রতিদিন ফোন করছেন বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু ছেলের চিকিৎসা না করিয়ে তিনি বাড়ি যাবেন কীভাবে?