সীমানার নিকট-দূর

চারখাই বাজার থেকে সুতারকান্দির দিকে কিছুটা এগোলে তাদের চোখে পড়বে!
বড় রাস্তার পাশের ঢালে ছাপড়া। ছাপড়া বলতে যে ঘর বোঝায় তা নয়, নৌকার একখানা ছই। ওপরে নীল রঙের পলিথিন। নিচেও তাই। বৃষ্টি এলে কোনোভাবেই ঢুকবে না। তবে হাত দশেক পরের মাঠ তলালে অন্য কথা। এখানে একজন। ভেবে নেওয়া যাক তার নাম ফুলমতি।
ফুলমতির ছাপড়ার পরেই দুটো দোকান। সব সময় শাটার নামানো। সেখানে বসে আছে একজন। তার নাম চাইলেই ভাবা যাবে না। লোকটা ফকির না বৈরাগী, সাধু না দরবেশ, ফকির না সন্ন্যাসী—সে পরিচয় নিরূপণ করা যায়নি। তাই তার কোনো নাম ভেবে নেয়া যাচ্ছে না। বেগানা আওয়ারা। কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, সে কথা কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করেনি।
সে-কথা ফুলমতিকেও কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। কিন্তু সবাই তো জানে, ফুলমতির মতো বেদেনিরা কিছুদিন বাদেই এখানে আসে। আজকাল তাদের আর নৌকার বহর নেই। দলবেঁধেও আসে না। দলের সবাই কাছাকাছি ভাগ হয়ে যায়। একেক জায়গায় এক-দুখানা ছইয়ের সংসার তারা কিছুদিনের জন্যে পাতে। এমনকি বেদেনিদের লাগ ভেলকি লাগানোর মতো, এই যে নৌকার ছইখানার নিচে সংসার পেতেছে, এই ছইখানা বা কোত্থেকে এল সে সন্দেহও অনেকের ঘোচে না। অথচ, এই মাঠটা পুব দিকে সিধে পাড়ি দিলে সুরমা। শান্ত নদী। সেখানে কোনো নৌকাও কেউ দেখেনি। আবার সুতারকান্দির দিকে মাইল দুয়েক এগোলে খরস্রোতা কুশিয়ারা। সেখানে দিনের পর দিন নৌকা বেঁধে রাখার সুযোগ নেই।
তবু, চারখাই বাজারের লোকজন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানে, এমন বেদেরা হঠাৎ আসে, একদিন হঠাৎ চলেও যায়। ফুলমতি তার স্বামী সুরুজ আর বছর তিনেকের মেয়েটিকে নিয়ে কয়েক দিন হলো এসেছে। সুরুজ সাধারণত ওই ছইয়ের ছাউনিতেই থাকে। কখনো ফুলমতির সঙ্গে মেয়েসহ বাজারের দিকে আসে। পোস্টাপিসের উল্টো পাশের চায়ের দোকানে বসে কি দাঁড়ায়। আবার চলে যায়। ফুলমতি আশেপাশের গ্রামে যায়। বিকেলে ফেরে। বিকেলের বাজার বসলে এখানে আসন। সুরুজ তখন ছাপড়ার বাইরে ভাতের হাঁড়ি চাপায়। ফুলমতি ফেরে। সুরুজ মেয়েকে নিয়ে আবার বের হয়। এভাবে এখানে কিছুদিন কাটানোর পরে তারা অন্যত্র চলে যাবে। কোথায় যাবে? তাও জানে কেউ কেউ। রাণাপিং কি ঢাকা উত্তর, কি গোলাপগঞ্জ অথবা হেমিতগঞ্জের দিকে। সুরমার তীর ধরে যত দূর এগোনো যায়, যেখানে দিন ও রাতে মানুষের আনাগোনা; যাকে বলে গঞ্জ—তেমন যেকোনো দিকে।
কিন্তু ওই লোকটা? বাজারের কেউ কি আগে এখানে দেখেছে? মনে করতে পারে না। কংক্রিটের এই দোকান দুটোর নিচে লোকটাকে প্রথম বসা দেখে ফুলমতিও তাই ভাবে। এত গ্রাম সে পাড়ি দেয়, এখানে-সেখানে ঘোরে, এই লোকটাকে আগে এখানে দেখেনি। এই দোকান দুটো যে খোলে না, তা-ই বা জানল কীভাবে? ওইভাবেই বসে থাকবে? এখন সন্ধ্যার মুখে বসে আছে কেন? দোকান দুটোর পেছনে একটা ফিলিং স্টেশন। বহু দিন বন্ধ। সীমান্তে এমন ফিলিং স্টেশন একসময় হয়েছিল, কিন্তু প্রায় সবই এখন অচল। এরপর কয়েক একর জায়গাজুড়ে পাওয়ার স্টেশনের কাজ হচ্ছে। বাজারের লোকেরা বলে, কারেন্টোর অফিস। বিকেলের দিকে শ্রমিকেরা চলে গেছে। তারপর বাজারের আর কোনো ছাপ নেই। রাস্তার দুপাশে সার সার বাড়িঘর। রাস্তার উল্টো পাশে অবশ্য বাড়িঘর একটু ভেতরে। সামনের দিকে পুকুর অথবা বড় বড় ডোবা। ডোবার মাঝখান থেকে পথ এসে মিশেছে।
শুঁটকিতে দেয়ার জন্যে শিমের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে ফুলমতি লোকটাকে দেখে। একবার ভাবে, মোবাইল করে সুরুজের কাছে জানতে চাইবে, ওই লোকটা কোন সময় ওই জায়গায় এসেছে? কেন এসেছে? কিন্তু সুরুজ মেয়েকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বাজারের দিকে গেছে মোবাইলে চার্জ দিতে।
শিমের আঁশ ছাড়ায় আর ফুলমতি লোকটাকে দেখে। পরনে বড়সড় একখানা গামছা। ওপরে কিছু নেই। খালি গা। গলায় লাল কাপড়ের সঙ্গে অসংখ্য মালা। মুখে বুকসমান হুঁচলো দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল, তার কিছু মুখের দিকে এসে পড়েছে। বসেছে রাস্তার দিকের দোকানটার সামনের শাটারে হেলান দিয়ে। মুখ ফুলমতির ছাপড়ার দিকে।
আচ্ছা জ্বালা! ফুলমতির মনে হয়। বাজারে কত লোক দেখে তাকে। গ্রামের রাস্তায় হাঁটার সময়ে দেখে। মানুষের চোখ তো সে ভালোই চেনে। তা ছাড়া তাদের মতো বেদেনির চালচলন গ্রাম কি শহরের পুরুষ-মহিলা সবাই কী চোখে দেখে তা-ও তার জানা আছে। এমনকি একলা পেলে কত পুরুষ কী সব বলে। কীভাবে ডাকে, কী ইশারা করে—সবই সে জানে। কত কত দিন হলো, সারাটা দিন এই দুটো পায়ে হেঁটেই তো সে মানুষ দেখে। মানুষ তাকে দেখে। কিন্তু এমন
আজব মানুষ যেন সে কখনো দেখেনি। দেখলেও, একটানা এভাবে তার দিকে কেউ তাকিয়ে থেকেছে? মনে পড়ে না। আজব মানুষ! তা এ অঞ্চলে এমন আজব মানুষ আসতেই পারে। এখানে আসার আগে সে শুনেছে, এখানে পির-ফকিরের অভাব নাই। কত কত মাজার। আবার, বাউল-বৈরাগী আছে। সাধু-সন্ন্যাসীও অনেক। যদিও এই কয়েক দিনে, চন্দরপুরের দিক থেকে এদিকে আসার পরে একজনকেও দেখেনি সে। আর আজ দেখল যখন একেবারে সামনেই?
লোকটা ফকির না সন্ন্যাসী? কোনটা কে জানে? ছোট কলসির পানিতে শুঁটকি ভেজায় ফুলমতি। তারপর বঁটির মুখ ঘুরিয়ে লোকটাকে আরও ভালো করে দেখার জন্যে বসে। চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, ফকির নাকি সন্ন্যাসী নাকি বৈরাগী। ফুলমতি শুনেছে এই বড় রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোনোর পরে মাঠের ভিতর দিয়ে আড়াআড়ি গেলে বৈরাগী বাজার বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে বড় বড় ড্যাগে রান্না হয়। চন্দরপুর থেকে এখানে আসার সময় ভেবেছিল যাবে। যাওয়া হয়নি। তবে, তাদের দলের কয়েকজন যে গোলাপগঞ্জের দিকে গেছে, সেখানে নাকি একজন বড় পিরের থান আছে আবার বৈরাগীদের আখড়াও আছে। এরপর সে আর সুরুজ যদি গোলাপগঞ্জ যায়, ভেবে রেখেছে, দেখতে যাবে।
লোকটা কি এমন যে কোনো জায়গায় ছিল, তারপর এখানে এসেছে? কেন এসেছে? বাজারে আর জায়গা নেই? পোস্টাপিসের বারান্দা আছে। একটা ছোট হাসপাতাল আর মসজিদ। মসজিদের পরে যেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় এমন একটা বাড়ি। তারপর না এই প্রায় হাওড়ের কিনারায় ফুলমতিরা দিন কয়েকের জন্যে ছাপড়া পেতেছে? এখানেই লোকটাকে আসতে হবে? ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের বাড়িটায় গেলেই তো পারে। বাইরে দাঁড়ালে খাওয়া না দিক, পেছনে গেলে দেবে। ওটার সামনের রাস্তার উল্টো পাশে বড় একটা মার্কেট। সেখানে কত মানুষ। তা বসে থাকবা তো ওই জায়গায়!
ভাতের হাঁড়িতে হাতা দিয়ে তুলতেই ফুলমতির গায়ে মাথায় একফোঁটা বৃষ্টি পড়ে। এ এক আজব জায়গা। বৃষ্টি আসার কোনো সময়-অসময় নেই। যখন-তখন আসে। এই ভাদ্দরের শেষেও সন্ধ্যার মুখে বৃষ্টি। ভাত নামিয়ে গড় দেয়। এরপর শুঁটকির তরকারি চুলায় চাপায়। বৃষ্টি বাড়ে। কড়াইয়ের ওপরে একটা ঢাকনা আর তার উপরে কুঁচপাতা দিয়ে চুলা ঢেকে ফুলমতি ভাবে, লোকটার কাছে জানতে চাইবে, এখানে কী? নাকি এই হাত দশেক জায়গা এগিয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে?
সুরুজ কোনো কাজের না। যাওয়ার আগে বলে যাবে না, এই লোকটা এখানে বসে আছে। নাকি সুরুজও গেছে আর লোকটা ওখানে এসে বসেছে? আগে বসলেও সুরুজ তাকে বলত না। সারাটা জীবন লোকটা চুপচাপ। মেন্দামারা। এই যে মেয়েটাকে রাখে এতেও যেন আগ্রহ নেই। শুধু আগ্রহ ছিল... ফুলমতি আর চকিতে লোকটাকে দেখে তারপর ভাবে, না থাক, আগের বহরের নোলকেরও দোষ ছিল। ও সুরুজের দিকে অত না ঢললেও পারত। ফুলমতি তার সই নোলক আর স্বামী সুরুজের বিষয় নিয়ে ভাবনা আবার দানা বাঁধার আগে লোকটা জানতে চাইল, ‘কী রন্ধন হয়?’
দেখ কাণ্ড! কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ জানতে চায়, কী রন্ধন হয়? রন্ধন অর্থ যে রান্না ফুলমতি লোকটার জানতে চাওয়ায় বুঝেছে।
ফুলমতির মনে হয়, অন্ধকারের ভেতরে খুব গম্ভীর ভারী গলায় কেউ আরও কিছু বলছে। কিন্তু সে তা শুনতে পাচ্ছে না। ঘরের মুখ থেকে সে একটু ভেতরে ঢুকে ভাবে, আগে চার্জার লাইট জ্বালাবে না মোবাইল করবে সুরুজকে? এ সময় ওপরের দিকে গোঁজা চার্জারের সুইচে টিপবার আগে আবার সে লোকটাকে দেখে। এখন আর মুখখানা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না। তবে বসার ভঙ্গিটা একই রকম আর স্পষ্ট।
ছইয়ের ভেতরে আলো। ওদিকে মেঘ ডাকে, কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে না। ফুলমতি মোবাইল খোঁজে। সুরুজকে ফোন করার জন্যে মোবাইল হাতে নিতেই আবার লোকটার গলা। এবার যেন কানের কাছেই বাজল, ‘কী সই, কী রন্ধন করো?’
ফুলমতি ঘাড় ঘোরায়। না লোকটা তো একই জায়গায় বসে আছে। তাহলে? মনে হলো যেন একেবারে ঘরের কাছে এসে তার কাছে জানতে চেয়েছে! এ সময় সুরুজের ফোন আসে। ফুলমতি লোকটার কথা বলার আগেই, সুরুজ বলে যে হেতিমগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। সর্দার ডেকেছে। ফুলমতি জানতে চায়, মেয়েকেও নিয়ে যাচ্ছে? সুরুজ বলে, তারা বাসে উঠে গেছে। ফুলমতি জানতে চায়, হেতিমগঞ্জ তো গোলাপগঞ্জেরও পরে। এখনই তো রাত হয়ে গেছে। তাদের আসতে আসতে অনেক রাত হবে। সুরুজের কথা শুনতে শুনতে ভাবে, লোকটার কথা বলবে। কিন্তু তার আগেই সুরুজ জানায়, না, বাসে ছেড়ে দিয়েছে। বেশিক্ষণ লাগবে না। এই ঘণ্টাখানেক। তারপর বাসের হর্নে সুরুজের কথা শোনা যায় না। ফুলমতি জানে, অন্তত দুই ঘণ্টা তো লাগবেই।
ফোন রেখে ফিরতেই লোকটা জানতে না চাইলেও ফুলমতি যেন কথাটা আবার শোনে। কিন্তু অন্ধকারে লোকটাকে আর ঠিকঠাক দেখতে পায় না। শুধু এক আবছায়া। একটা বড়োসড়ো পুটলি বসে আছে। আর তখনই এদিকে যাওয়া সুতারাকান্দি কি জকিগঞ্জমুখী একটা বাসের হেডলাইটের আলো সেখানে তেরসা হয়ে পড়ে। তাতে ফুলমতি লোকটাকে দেখতে পায়। আলোটা সরে যেতে সে ভাবে, কী চোখ! কীভাবে চেয়ে আছে!
আবারও একই কথা শোনে সে। ভাবে বলে, তা দিয়ে তোমার কী দরকার?
এবারও কি লোকটা একই কথা জানতে চাইল? নাকি সে ভুল শুনছে?
কড়াইয়ের ওপরের ঢাকনাটা নড়ে। ফুলমতি চার্জারের আলোয় শুঁটকির তরকারি দেখে। নামানোর সময় হয়ে গেছে। সুরুজ আসার পরে খাওয়ার আগে আর একবার ফুটিয়ে ঝোল একটু টানাবে।
চুলা থেকে কড়াই নামাতেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়। আর তখনই লোকটা বলে, ‘কী, কও? কী রন্ধন হয়?‘
ফুলমতি ভাবে, লোকটার খাওয়ার জন্যে এমন করে? সে বলে, ‘কেন? কী দরকার?’
লোকটা কথা বলে না।
ফুলমতি বলে, ‘আপনার বাড়ি কই?’
লোকটা বলে, ‘কীসের বাড়ি কীসের ঘর, চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার!’
ফুলমতি বিড়বিড় করে, ‘ঢং!’
লোকটা যেন তা শোনে, ‘কী, ঢং? তাই সত্যি! চোখ বোজো, দুনিয়া আন্ধার!’ ফুলমতি কিছু বলার আগে লোকটা আবার জানতে চায়, ‘কী রন্ধন হইল?’
‘কেন, খাবা?’
‘উহু। শোনব—’
মহা জ্বালা! আপদ! সাতঘাট ঘোরা ফুলমতি এমন মানুষ যেন জন্মে দেখেনি!
‘কী শোনবা?’
‘কী ব্যঞ্জন রন্ধন হইল!’
‘দরকার নাই।’
‘কেন? দরকার নাই কেন? ফকির সন্ন্যাসী মুসাফিরের পেট নাই? খিদা নাই। জঠরের জ্বালা নাই। অঙ্গের বেদন নাই?’
‘অঙ্গের বেদন?’
লোকটা আর উত্তর দেয় না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বেশ লম্বা। অন্ধকারেও বোঝা যায়। ঝুঁকে হাঁটে। কোথায় যায়? রাস্তায়? না, ফুলমতির ছাপড়ার দিকে আসতে হলে রাস্তার দিকে কয়েক কদম এগোতে হয়। তখন লোকটার মুখে একটা মোটরসাইকেলের আলো পড়ে।
লোকটা ফুলমতির ছাপড়ার দিকে আসছে। ফুলমতি ছাপড়ার মুখ থেকে একটু ভেতরে ঢোকে। জানে না কেন। তারপর লোকটা ছাপড়ার মুখে কুঁজো হয়ে বসতেই, চার্জারের আলোয় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুলমতির মনে হয়, লোকটার পেটে কোনো খিদে নেই। তবু হামাগুড়ি দিয়ে সে ছাপড়ায় ঢুকছে। ভাতের হাঁড়ি কিংবা তরকারির কড়াই সে দেখছে না, তবু ঢুকছে।...