সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নিত এহসান গ্রুপ: র‌্যাব

এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর ভাই আবুল বাশার খানকে শুক্রবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়
ছবি: সংগৃহীত

পিরোজপুরভিত্তিক এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব বলেছে, একসময় ৯০০ টাকা বেতনে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানে শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

প্রতারণা ও জালিয়াতি করে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাগীব আহসান ও তাঁর ভাই আবুল বাশার খানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। আজ শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন র‍্যাবের কর্মকর্তারা।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব হাসানের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা চলছে। প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করছেন গ্রাহকেরা। অনেক গ্রাহক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করছেন। এসব অভিযোগের ছায়া তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ার পর গতকাল রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

এহসান গ্রুপ মোট কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি এই র‌্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যে তথ্য পাওয়া অনুসারে গ্রাহকদের ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা। এমনও ভুক্তভোগী আছেন, যিনি একাই ১৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখবে। রাগীব হাসান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা নিয়ে গ্রুপের যাত্রা শুরু করেন। এখন গ্রাহক কত আছে, তা তদন্তের পর বলা যাবে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, গ্রাহক ৫৫ হাজার। আবার কেউ কেউ বলছেন, গ্রাহক এক লাখের বেশি।

রাগীব আহসান গড়ে তুলেছেন ১৭টি প্রতিষ্ঠান
ছবি: সংগৃহীত

র‌্যাবের তথ্যমতে, রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি সম্পন্ন করে পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি নেন। ২০০৬-২০০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময় তিনি মাল্টিপারপাস কোম্পানির আদ্যোপান্ত রপ্ত করেন। পরবর্তী সময়ে নিজে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

রাগীব আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, এহসান গ্রুপে তিন শতাধিক কর্মী রয়েছেন। তাঁদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। গ্রাহক সংগ্রহ করলে বিনিয়োগের ২০ শতাংশ অর্থ পাওয়ার প্রলোভন দেখানো হতো কর্মীদের। তবে গ্রাহকদের মতো কর্মীরাও প্রতারিত হয়েছেন। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবা আবদুর রব প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এ ছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহপরিচালক, অন্য দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে পিরোজপুর পৌরসভার খলিশাখালী এলাকায় এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব আহসান। এরপর পিরোজপুর পৌর শহরের সিও অফিস মোড়সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম দেওয়া হয় এহসান গ্রুপ।

এখন এই গ্রুপের নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো এহসান এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, নুর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নুরজাহান মহিলা মাদ্রাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার এবং এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম। ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা–জমি করেছেন।