সুনামই ‘কাল’ হলেও সুন্দরবন ছাড়বেন না ‘টাইগার গনি’
সুন্দরবনের বীর হিসেবে পরিচিত ‘টাইগার গনি’ সম্ভব হলে গোটা সুন্দরবনকে রেখে দিতে চান নিজের বুকের ভেতর। তিনি যেভাবে শ্বাপদসংকুল বাঘের ডেরা থেকে বনজীবীদের ফিরিয়ে আনেন, সেই গল্প পড়ে পাঠক মুগ্ধ হন। গনি তাঁদের গ্রামের সন্তান বলে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চী গ্রামের মানুষের গর্বও কম নয়।
বর্ষাকালে সেদিন দখিনা বাতাস বইছে পশ্চিম সুন্দরবনে। মাথাভাঙ্গা নদী ধরে এগিয়েছিলেন গনি আর তাঁর বাবা বদরউদ্দীন গাজী। জোয়ারে অনেক মাছ উঠেছে জালে। খুশিতে চকচক করছে পিতা-পুত্রের চোখ। তখনই আকাশ কালো হয়ে গেল আষাঢ়ের মেঘে। দমকে দমকে উঠল ঝোড়ো বাতাস। মুহূর্ত মাত্র স্থির থাকা দায়। হাতের পাতা ওলটানোর মতো উল্টে গেল তাঁদের মাছভরা ছোট্ট নৌকাটি।
এখন পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তির মরদেহ ফিরিয়ে এনেছেন গনি। আক্রমণের শিকার ২৬ জনের কাছে গনি পৌঁছেছিলেন তাঁরা জীবিত থাকতেে। এর মধ্যে সুভাষ নামের একজন বেঁচেছিলেন অনেক দিন। বাকিদের বাঁচানো যায়নি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, ঘটনাস্থল থেকে চিকিৎসাকেন্দ্রের দূরত্বের জন্য। প্রত্যেকের মরদেহ পৌঁছে দিয়েছেন পরিবারের কাছে।
সুন্দরবনঘেঁষা জনপদের সেই হতভাগা বনজীবীদের মা, সন্তান বা স্ত্রী অন্তত শেষবারের মতো দেখেছেন প্রিয়জনের মুখ। বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো মানুষটির ক্ষতবিক্ষত শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট দুটো হাত তুলে জানাজার দোয়াটুকু পড়তে পেরেছে সন্তান। শুধু উদ্ধার নয়, দাফন পর্যন্ত সব কাজের তদারকিও গনি নিজে উপস্থিত থেকে করেন।
অনেক সময় মরদেহের অবস্থা এমন হয় যে তাকিয়ে দেখাও কঠিন। গনি যেন এক হাতে ভালোবাসার জিয়ন কাঠি ধরে আরেক হাতে রাখেন নিজের জীবন বাজি।
‘টাইগার গনি’ হিসেবে পরিচিত মানুষটি শুধু বিপদাপন্ন বনজীবীকেই উদ্ধার করেন না, বাঘ সংরক্ষণেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। লোকালয়ে চলে আসা অসুস্থ বন্য প্রাণীকে সুস্থ করে আবার ছেড়ে দিয়ে এসেছেন বনে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েক বছর ধরে কাজগুলো করতে হচ্ছে বিনা পারিশ্রমিকে। দুঃসাহসী এ মানুষটির বনজীবনের গল্পের আড়ালে রয়েছে প্রতি দিনের অসংখ্য ক্ষত আর না পাওয়ার বেদনা। তাঁর সেই না জানা যাপনের কথা শুনতেই প্রথম আলো কথা বলেছে টাইগার গনি হিসেবে পরিচিত গনি গাজীর সঙ্গে।
গত ১২ মে গনি এসেছিলেন প্রথম আলোর কারওয়ান বাজারের কার্যালয়ে। কেমন আছেন প্রশ্ন শুনেই বললেন, ‘সুনামই আমার কাল হয়েছে।’ সুন্দরবন ছাড়া তাঁর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাই উপোস করে হলেও থাকতে হবে বনের কাছেই। এই বনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জন্ম থেকে। বন থেকে সে কবে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাই খুঁজে দেখতে হবে। সেই গল্প বলতে গিয়ে প্রথম আলোকে বললেন ৩৩ বছর আগের এক দুপুরের ঘটনা। গনির বয়স তখন ১১ বা ১২ বছর।
বর্ষাকালে সেদিন দখিনা বাতাস বইছে পশ্চিম সুন্দরবনে। মাথাভাঙ্গা নদী ধরে এগিয়েছিলেন গনি আর তাঁর বাবা বদরউদ্দীন গাজী। জোয়ারে অনেক মাছ উঠেছে জালে। খুশিতে চকচক করছে পিতা-পুত্রের চোখ। তখনই আকাশ কালো হয়ে গেল আষাঢ়ের মেঘে। দমকে দমকে উঠল ঝোড়ো বাতাস। মুহূর্ত মাত্র স্থির থাকা দায়। হাতের পাতা ওলটানোর মতো উল্টে গেল তাদের মাছভরা ছোট্ট নৌকাটি।
নৌকায় থাকা ড্রাম ধরে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সাঁতার কাটলেন দুজন। ঝড়ের বেগে চারদিকে কিছুই দেখা যায় না। মনে হচ্ছে এখনই ডুবে যাবে। ছোট হাত শিথিল হয়ে আসে দীর্ঘ সময় সাঁতার কাটতে কাটতে। প্রায় অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন গনি। তখনই পায়ে বাঁধল ডাঙার অস্তিত্ব। খানিকটা ধাতস্থ হলে দেখলেন, কয়েক হাত দূরে বাবাও আছেন। ছোট বেলার সেই দুর্যোগের গল্প বলতে বলতে স্বগতোক্তি করলেন, দুর্যোগ আর বিপর্যয় আমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে শিখিয়েছে সুন্দরবনকে।
বাঘের মুখ থেকে মানুষকে উদ্ধারের কাজও শুরু করেছিলেন মাঝি হিসেবেই। ২০০৭ সালে তিনি মাছ ধরতেন। একদিন বনে মধু সংগ্রহকারী দুজনকে বাঘে ধরে। বন বিভাগ সেখান থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে। এ দৃশ্য দেখে গনি গাজীর ইচ্ছা হয় উদ্ধারকাজে নিজেকে জড়ানোর। এরপরপরই তাঁর সুযোগ আসে বন বিভাগের ‘টাইগার রেসপন্স’ টিমের হয়ে কাজ করার। পরের বছরই তিনি হয়ে যান টিমের দলনেতা। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের হয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু প্রকল্প শেষ হতেই চলে যায় চাকরি। এরপর থেকে নির্দিষ্ট আয়ের আর কোনো পথ নেই গনি গাজীর।
২০২০ সালে তাঁর নতুন চাকরি হয় চট্টগ্রামের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে। সেখানে বসে বসে বন্য প্রাণীর দেখভাল করতে করতে মনে পড়ে সুন্দরবনের কথা। পরিচিতজনদের ফেসবুকে সুন্দরবনের ছবি দেখলেই মন খারাপ হয়। পরিবারের কথা ভেবে কোনোমতে দেড় বছর কাজ করেন কক্সবাজারের ডুলাহাজারায়। এরপর করোনার দোহাই দিয়ে ফিরে আসেন নিজের সেই কালিঞ্চী গ্রামে। কিন্তু অভাব তো আর আবেগ বোঝে না।
বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন। ঘরে আছে স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউসহ গনি গাজীর অসুস্থ বড় বোন। মোসাম্মত খোদেজা খাতুন নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন এই বড় বোনের সব দায়িত্বও তাঁর। এদিকে ছেলে শাহীনুর আলম এইচএসসি পাস করলেও তাঁর কোনো চাকরির ব্যবস্থা হয়নি।
বরং চাকরি দেওয়ার নাম করে একজন এক লাখ টাকা নিয়েছেন। যে টাকাটি গনি গাজীকে দিতে হয়েছে একটি এনজিও থেকে ধার করে। আসল তো দূরের কথা, বরং প্রতি মাসে এ টাকার সুদ দিতেই এখন প্রাণান্ত। এর মধ্যে অভাবের তাড়না এত তীব্র হয় যে সেই সুন্দরবনের মায়া ছেড়ে আবার আসতে হয়েছে অন্ন সংস্থানে।
‘স্থানীয় মানুষেরা বিষ দিয়ে মাছ ধরে কিন্তু গনি গাজী অভাবে পড়েও কখনো এ কাজটি করে না।’
এ বছরের শুরুতে একটি ভবন নির্মাণসামগ্রী বিক্রির দোকানে চাকরি নিয়ে রাজধানীতে আসেন তিনি। ব্যক্তিগত সততা আর কর্মহীন অবস্থা দেখে সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা একজন পরিচিত সাংবাদিক চাকরিটি জুটিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মানুষেরা বিষ দিয়ে মাছ ধরে কিন্তু গনি গাজী অভাবে পড়েও কখনো এ কাজটি করে না। আপনজনকে বাঘ হত্যা করেছে বলে স্থানীয় অনেকেরই বাঘের প্রতি ক্ষোভ রয়েছে। লোকালয়ে পেলে পিটিয়ে মারতে চায়। ঠিক এমন একটি অবস্থার মধ্যে গনি গাজী স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন।’
লজ্জা পরাজিত হয় ভাতের শূন্য হাঁড়ির কাছে। দিনমজুরদের সারিতে গিয়ে দাঁড়ান গনি।
যে গনির পুরোটা প্রাণজুড়ে সুন্দরবন তাঁর পক্ষে চাকরির জন্য ঢাকা শহরে থাকা আসলেই কঠিন। দ্বিতীয় কাজেও অল্প কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন যথারীতি। প্রথম আলোকে গনি গাজী বললেন, ‘এখানে আমার ঘুম আসত না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম, আমার সেই বন। মনে হইতো কেউ না কেউ বনে বিপদে পড়ছে। উদ্ধার করার কেউ নাই। আবার ভাবতাম, মানুষ যদি রাগ করে একটা বাঘ পিটায় মেরে ফেলে? এত অস্থির লাগত ঢাকা শহরে যে মাত্র দেড় মাস থেকে আবার ফিরে গেছি।’
‘বনের কাছে থাকি, এই আমার আনন্দ। কেউ বিপদে পড়লে দৌড়ে গেলে হয়তো মানুষটাকে বাঁচাতে পারব ভাবি।’
এই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত খুব সহজ ছিল না। এখন প্রতিদিন সে মূল্য দিচ্ছেন সেই বীর বাহাদুর টাইগার গনি। কালিঞ্চী গ্রাম থেকে ভেটখালী বাজার ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। সেই বাজারে দাঁড়িয়ে থাকেন মোটরসাইকেল চালকেরা। প্রতিজনের ট্রিপ ৩০ টাকা। দুজন উঠলে ৬০ টাকা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে সওয়ারি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন ভাড়ার বিনিময়ে। এজন্য মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে পারেন চালকেরা। গনি কয়েক দিন সেখানে গিয়েছেন উপার্জনের আশায়। মোটরসাইকেল চালক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো সওয়ারি তাঁর বাহনে উঠতে চান না। স্থানীয় মানুষ ভাবে, অন্য কোনো জরুরি কাজে এদিকে এসেছিলেন গনি ভাই। এত জনপ্রিয় মানুষ, দেশের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে যাকে নিয়ে প্রায়ই বড় বড় রঙিন ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ হয় সে মানুষ নিশ্চয়ই সওয়ারি তুলতে আসেনি।
অগত্যা বিফল হয়ে শূন্য হাতে গনি ফিরে আসেন বাড়িতে। কয়েক দিন পর শুনতে পান সুন্দরবনের মাছের ঘেরে মাটি কাটার কাজ চলছে। লজ্জা পরাজিত হয় ভাতের শূন্য হাঁড়ির কাছে।
দিনমজুরদের সারিতে গিয়ে দাঁড়ান গনি। সে সারির অন্যরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের চোখকে। যার সাহসের উদাহরণ দিয়ে সন্তানদের গল্প বলেন, সেই মানুষ আর যা–ই হোক দিনমজুরের দলে ভিড়তে পারেন না। এমন সময় হয়তো এগিয়ে আসেন প্রভাবশালী স্থানীয় কোনো নেতা। তিনিও ভুল বোঝেন এবং গনির কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, আসো একসঙ্গে চা খাই। ভাতের ক্ষুধার বন্দোবস্ত হয় না কিন্তু সুনামের খাতিরে কয়েক কাপ চা ঠিকই খেয়ে ফেলতে হয় হাসিমুখে।
সুখ্যাতির এই যন্ত্রণা জীবন দিয়ে টের পাচ্ছেন সুন্দরবনের সবচেয়ে সাহসী মানুষটি। যে বন, মানুষ আর বন্য প্রাণী ভালোবেসে বারবার ফিরে আসেন বনের কাছে। চাকরি হারিয়েও বিনা মূল্যে সেবা করে যাচ্ছেন বিপদাপন্ন মানুষের। গত ডিসেম্বরেও ডাক পেয়েই ছুটে গিয়ে পায়রাখালী থেকে উদ্ধার করেছিলেন মুজিবর রহমান নামে এক বনজীবীর মরদেহ।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত রিয়েলিটি শো ‘দাদাগিরি’তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে আক্ষেপ করতে করতে বললেন, চাল কেনার টাকাই থাকে না আর তো পাসপোর্ট বানানোর খরচ। সেই শোতে অংশ নিতে না পারার আফসোসে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে মানুষটির মুখ। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘তবে বনের কাছে থাকি এই আমার আনন্দ। কেউ বিপদে পড়লে দৌড়ে গেলে হয়তো মানুষটাকে বাঁচাতে পারব ভাবি।’
বন বিভাগের টাইগার রেসপন্স টিমের প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় তিন বছর ধরেই বেকার গনি গাজী। তিনি বলেন, ‘তাই বলে কেউ বিপদে পড়েছে শুনে আমি তাকে বাঁচাতে যাইনি এমন কখনো ঘটে নাই। বনঘেঁষা মানুষ যেমন নিরাপদ থাকবে তেমনি বাঘও নিরাপদ থাকবে মানুষের আক্রমণ থেকে। আমি এখন অনলাইনে মধু বিক্রির চেষ্টা করি। সব মিলে মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকার মতো আয় হয়। সংসারে খাওয়ার মুখ পাঁচজনের।’
সব মানুষের কাছে সাহসের জন্য খ্যাতিমান সুন্দরবনের ‘টাইগার গনির’ প্রায় প্রতিটি দিনই যায় সংসারের কাছে পরাজিত হয়ে। বন বিভাগের চাকরি হলেও ভয় আছে, যদি অন্য কোনো বনে বদলি করে দেয়।
গনি চান সুন্দরবনে থাকতে। প্রথম আলোকে বললেন, ‘বন বিভাগ যদি সমন্বয় করে চাকরি দেয়, তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। না দিলে এভাবেই থাকব, কিন্তু সুন্দরবন ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না।’ ভালোবাসা গভীর হলে মানুষ নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে। নিত্য দিনের নানা পরাজয়ও এতটুকু ম্লান করতে পারেনি সুন্দরবনের প্রতি টাইগার গনির ভালোবাসাকে।