সুবর্ণজয়ন্তীতে উজ্জ্বল বিসিপিএস

দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকতে পেরেছে বিসিপিএস। বিদেশেও প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল।

বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সুবর্ণজয়ন্তীতে শোভাযাত্রা বের করেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকালে রাজধানীর মহাখালীতে
ছবি: প্রথম আলো

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং চিকিৎসাশাস্ত্রে এফসিপিএস (ফেলো অব কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) ডিগ্রি নিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে। শুধু তিনি নন, তাঁর মন্ত্রিসভার আরও দুজন সদস্য—পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন বাংলাদেশের একই প্রতিষ্ঠান থেকে।

প্রতিষ্ঠানটির নাম বাংলাদেশ কলেজ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস), যার বয়স ৫০ বছর হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৬ জুন প্রতিষ্ঠা করেন বিসিপিএস। উদ্দেশ্য ছিল, মানসম্পন্ন চিকিৎসাশিক্ষা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চাহিদা মেটানো।

স্বাধীনতার সময় দেশে মেডিকেল কলেজ ছিল আটটি। এসব কলেজ থেকে এমবিবিএস উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা, অর্থাৎ এফআরসিএস বা এমআরসিপি ডিগ্রির জন্য যেতে হতো বিলেতে, ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজে। সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ পেতেন। সবার জন্য এই সুযোগ উন্মুক্ত করতে রয়্যাল কলেজের আদলে বিসিপিএস গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে অধ্যাপক কে এস হককে সভাপতি করে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। অধ্যাপক কাজী সামসুল হক ও জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কলেজকে এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কলেজের কার্যক্রম শুরু হয় ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিসেন অ্যান্ড রিসার্চে (আইপিজিএমআর)। ওই বছরের জুলাই মাসেই বাংলাদেশে প্রথম এফসিপিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৭৫৬ জন চিকিৎসক এফসিপিএস এবং ৩ হাজার ৩৪৫ জন এমসিপিএস (মেম্বার অব কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) সনদ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দুবার স্থান বদল করে ১৯৮২ সাল থেকে রাজধানীর মহাখালীতে স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ টিটো মিয়া এই প্রতিষ্ঠান থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে–বিদেশে বিসিপিএসের সুনাম মূলত এর কঠোর নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলার কারণে। এর পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মান অতি উচ্চপর্যায়ে রাখা হয়। এর সনদ পাওয়া চিকিৎসকের মানও উঁচু পর্যায়ের।

এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকেরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য প্রথমে বিসিপিএসে নিবন্ধন করেন। নির্দিষ্ট সময় পর তাঁদের পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার জন্য নিজ উদ্যোগে প্রস্তুতি নিতে হয়। চিকিৎসকেরা সাধারণ পেশাচর্চার পাশাপাশি এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন। বিসিপিএসের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য অবহিতকরণ ক্লাসের ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষায় পাস নম্বর ৭০। বিসিপিএসের সাম্মানিক সম্পাদক অধ্যাপক বিল্লাল আলম বলেন, পরীক্ষায় পাসের হার ৭ থেকে ১০ শতাংশ।

বিসিপিএস বর্তমানে ২২টি সাধারণ বিষয়ে এবং ৩৭টি বিশেষায়িত বিষয়ে ডিগ্রি দেয়। এর মধ্যে কিছু মৌলিক বিষয়ে ক্লাসও নেয়। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের পাঠদানের মান বাড়াতে সারা বছর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এখানে নিয়মিত কর্মশালা ও সেমিনার হয়।

বিশেষজ্ঞ বিনিময় ও দেশে–বিদেশে স্বীকৃতি

পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালের সঙ্গে পরীক্ষক বিনিময় করে বিসিপিএস। অর্থাৎ বিদেশি পরীক্ষকেরা বাংলাদেশের পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন এবং বিসিপিএসের পরীক্ষকেরা বিদেশের পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেন।

যুক্তরাজ্যের একাধিক রয়্যাল কলেজ, সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি কমিশন ফর হেলথ স্পেশালিটিজ, অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইনস্টিটিউট, পাকিস্তান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস, মালয়েশিয়া মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে বিসিপিএসের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে।

বিসিপিএসের দেওয়া সনদ ও ডিগ্রি পৃথিবীর অনেক দেশে পেশাগত নিবন্ধন, উচ্চতর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও চাকরির জন্য স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সনদ নিয়ে প্রায় এক হাজার চিকিৎসক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেশা চর্চা করছেন।

দেশের নামকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রায় সবাই এই কলেজের ফেলো। ফেলোদের সম্মানও দিয়েছে রাষ্ট্র তথা সরকার। এ পর্যন্ত ছয়জন ফেলোকে জাতীয় অধ্যাপক করা হয়েছে। ১১ জন ফেলো স্বাধীনতা পুরস্কার ও পাঁচজন একুশে পদক পেয়েছেন। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন ফেলো।

বাংলাদেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। সেই প্রভাব থেকে এখনো নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে বিসিপিএস। এখানে দলাদলির চেয়ে পেশাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাই সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি এখনো উজ্জ্বল।