সূর্যমুখী ফুলে মেলে স্বাস্থ্যকর তেল

সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যমুখী সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। ছবি: লেখক
সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যমুখী সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। ছবি: লেখক

ছোটবেলায় সূর্যমুখীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল সেই সত্তুরের দশকে। প্রতিবেশী এক চাচা সূর্যমুখীর চাষ করেছিলেন। মাঠের মধ্যে একটি জমিতে তিনি চাষ করেছিলেন। আর কেউ করেননি। তারপর আমাদের মাঠে কোনো দিনও সূর্যমুখী নজরে আসেনি। বলতে গেলে তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ সূর্যমুখীচাষি আমাদের গ্রামে। তিনিও জীবনে একবারই এই সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন, দ্বিতীয়বার অবশ্যই নয়।

আমার চাচা বীজ পেয়েছিলেন বিদেশিদের কাছ থেকে। বিদেশিরা তখন সূর্যমুখী উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ, উৎসাহিত ও পরামর্শ দিতে কাজ করছিলেন বাংলাদেশে। যাহোক শৈশবে সেই সূর্যমুখীখেতে ছুটে যাওয়ার স্মৃতি আমার এখনো স্পষ্ট। যখন ফুটেছিল সেই দৃষ্টিনন্দন (আমাদের কাছে অচেনা) ফুলটি। আহা, কত সুন্দর, একটি জমিতে ফুটেছে সূর্যমুখী, যেন পুরো মাঠ হাসছে প্রাণ খুলে। শিশু মন নেচে উঠেছে সেই হাসির দোলায়। কিন্তু রহস্যটা অনেক জটিল, যখন দেখলাম সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ফুল সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে। এই জন্যই নাম তার সূর্যমুখী?

সূর্যমুখী দেখতে রূপময় নয় গুণেও অনন্য। সূর্যমুখীর বীজের তেল স্বাস্থ্যর জন্য অসাধারণ। অন্যান্য তেলবীজে যেসব ক্ষতিকারক উপাদান (বিশেষ করে কোলেস্টেরল) থাকে সূর্যমুখীতে তা নেই। বরং আরও উপকারী উপাদান ও পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। ঢাকাসহ দেশের মেট্রো সিটিগুলোর চেইন মার্কেটে ও সাধারণ মুদিদোকানে এমনকি সারা দেশের শহর–গ্রামের বাজারের প্রসিদ্ধ কিছু কিছু মুদিদোকানগুলোতে বোতলজাত সূর্যমুখীর তেল দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির নিজস্ব উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা। দাম অনেক, তাই সাধারণের খাদ্যতালিকায় সূর্যমুখী তেলের প্রচলন নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য সূর্যমুখীর তেলের বিকল্প নেই। ভারতে এই তেল খুবই জনপ্রিয় ও প্রচলন আছে চোখে লাগার মতো। অন্য তেলের চেয়ে যদিও একটু দাম বেশি, তা সহনশীল ভারতের বাজারে। তাই ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অঞ্চলভেদে সূর্যমুখী তেলের ব্যবহার লক্ষণীয়। উৎপাদনও ভারতে সূর্যমুখীর মন্দ নয়। সব কটি তেলবীজের তালিকায় সূর্যমুখীও ভারতীয় উৎপাদিত তেলবীজের অন্তর্ভুক্ত ও প্রচলিত মোটামুটি সহজলভ্য তেলবীজ, যা আমাদের দেশে সূর্যমুখী তেল সাধারণের সঙ্গে সাধারণ পরিচয় ঘটাতে এখনো অসফল। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জল, মাটি সূর্যমুখী চাষের অনুকূলে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে, প্রসার লাভ করছে না সে রকমভাবে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে তার দাম। অথচ বাংলাদেশে সূর্যমুখীর সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমরা বিদেশ থেকে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল আমদানি করি, তাতে আছে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। অথচ আমরা যদি দেশীয়ভাবে সূর্যমুখীর বীজকে প্রধান্য দিয়ে রিফাইন্ড না করেও শুধু ঘানিতে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করি। আমাদের এই ভোজ্যতেলও হতে পারে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাস্থ্যকর।

সুস্বাস্থ্যের জন্য সূর্যমুখীর তেলের বিকল্প নেই। ছবি: লেখক
সুস্বাস্থ্যের জন্য সূর্যমুখীর তেলের বিকল্প নেই। ছবি: লেখক

সূর্যমুখী উৎপাদনে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ হতে পারে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার অনুকূলে শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি মাথায় রেখে। সরকারিভাবে রিফাইন্ড মেশিনারি সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে রিফাইন্ড মেশিন স্থাপন করা গেলে ও সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল সংগ্রহ ও রিফাইন্ড সূর্যমুখী তেল বোতলজাত, বাজারজাত করা গেলে, প্রয়োজনে সরকারি ভর্তুকি দিয়ে হলেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা গেলে, তেল সহজলভ্য হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা সয়াবিন তেলের ওপর নির্ভরশীল। এই তেলে রয়েছে স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান, যা আমাদের স্থানীয়ভাবে ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেলেও ছিল না। সরিষার তেলই ছিল বাঙালির তেলের চাহিদা পূরণের প্রধান তৈলবীজ। আরও ছিল তিল, তিসি, বাদাম। এই তিনটি তৈলবীজের তেলেও ক্ষতিকারক উপাদান এতটা নেই, যতটা আমদানি করা সয়াবিন তেলে আছে। একসময় গরু দিয়ে গাছ টেনে যে ঘানিতে তেল বের করা হতো, তার পরিবর্তন এসেছিল মেশিনের ঘানি। এই ঘানিতে ভাঙানো তেল এমনিই ব্যবহার করা হতো। কোনো ধরনের রিফাইন্ড ছাড়াই। এ তেলও নিরাপদ ছিল।

গরুকে টেনে আনার দরকার নেই গাছ টেনে ঘানি চালানোর জন্য। এটা প্রাণীটির প্রতি অন্যায় করা হয়। মেশিনের সেই ঘানি বসিয়ে রিফাইন্ডহীন ভাঙানো তেল স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করাটাও আমার মনে হয় স্বাস্থ্যসম্মত। প্রযুক্তির উন্নত ভার্সন বাদ দিয়ে কখনো কখনো পেছনের প্রযুক্তিতে ফিরে যাওয়াও ভালো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।

সূর্যমুখীই হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষার গুণসম্পন্ন তৈলবীজ। আমরা যেভাবেই তার তেল আহরণ করি না কেন, তা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। আমাদের তেলসংক্রান্ত জটিল সব অসুখের হাত থেকে মুক্তি পেতে, তেলের ব্যবহার বাদ দিতে হয় খাবারে, তেলেরও দরকার আছে শরীরের জন্য। সেই অর্থে সূর্যমুখীর তেল হতে পারে আমাদের জন্য আশীর্বাদ।

বাংলাদেশের অসংখ্য চরাঞ্চল ও হাওরের জমিতেও সূর্যমুখী উৎপাদন করা যেতে পারে বাণিজ্যিকভাবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় অনেক জমিতেই প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। এসব জমিতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সূর্যমুখী উৎপাদনে আগ্রহী হতে পারেন কৃষকেরা। বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব এসে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ, কৃষি গবেষণা বিভাগ এখন অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ, কৃষিতে ভর্তুকিও চোখে লাগার মতো। কিন্তু কৃষকদের উন্নতি আসলে সে রকমভাবে হয়নি। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষকেরা বরাবরই বঞ্চিত বলা চলে। কৃষকদের দারিদ্র্যতা দূর করা না গেলে কৃষিতে আগ্রহ হারাবে কৃষিকে পেশা হিসেবে জীবিকা নির্বাহকারী কৃষক শ্রেণি।

সূর্যমুখী হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষার গুণসম্পন্ন তৈলবীজ। ছবি: লেখক
সূর্যমুখী হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষার গুণসম্পন্ন তৈলবীজ। ছবি: লেখক

কৃষকদের বীজ ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা প্রধান করে অন্তত কৃষকদের দিয়ে সূর্যমুখী উৎপাদন করিয়ে, সূর্যমুখীর বীজ যদি সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্য পরিশোধে ক্রয়নীতি বাস্তবায়ন করা যায়, যাতে করে মধ্যস্বত্বভোগীরা সেখানে অশুভ ছায়া ফেলতে না পারে। তাহলেই কৃষক উৎসাহ নিয়ে কাজটা করতে পারবেন। বাংলাদেশের কৃষক অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান। তাঁদের উদ্যমী করা গেলে দারুণ সুফল আশা করা যায়। সূর্যমুখী দেখতে যেমন হাসিখুশি, সূর্যমুখীর বীজের তেলও সুস্বাস্থ্যকর। পুষ্টিগুণে অন্য সব তেলবীজ থেকে শ্রেষ্ঠ।

আন্তর্জাতিক পুষ্টিবিদদের দেওয়া অনলাইন তথ্যসূত্র থেকে নেওয়া তথ্যমতে, সূর্যমুখী তেলে আছে মানবদেহের জন্য উপকারী ওমেগা ৯ ও ওমেগা ৬, আছে অলিক অ্যাসিড। সূর্যমুখীর তেলে আছে শতকরা ১০০ ভাগ উপকারী ফ্যাট। আরও আছে কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ও পানি। সূর্যমুখীর তেল সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলমুক্ত। আছে ভিটামিন ‘ই’, ভিটামিন ‘কে’–এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন, আছে মিনারেল। মুখের যত্নে দাঁতের জন্য উপকারী একমাত্র তেল। হৃদরোগী, ডায়াবেটিসের রোগী উচ্চ রক্তচাপের রোগী, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ। চমৎকার এনার্জির উৎসও সূর্যমুখীর তেল।

প্রকৃতিতে অসাধারণ এক রূপবান উদ্ভিদ সূর্যমুখী। পাগল করা সুন্দর তার ফুল। একজন ফুল ও প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে এমন উপলব্ধি আমার। ভারতের একরের পর একর জমিতে যখন সূর্যমুখীর ফুল হেসে ওঠে আপন স্বভাবজাত হাসিতে, বাংলাদেশেরও কোনো কোনো অঞ্চলে মাঠে ফোটে সূর্যমুখী, এই বাণিজ্যিক চাষবাস সূর্যমুখীর খেত দেখে সবার মন ভরে ওঠে। হলুদ রং আমার পছন্দ নয় কিন্তু হলুদ সূর্যমুখী আমাকে পাগল করে দেয় তার রূপবৈচিত্র্য দিয়ে। বাণিজ্যিক সূর্যমুখীর চাষ, যেন প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছে নতুন করে কেউ। সূর্যমুখী ফুলের চোরা গন্ধ বাতাসে দোল খেয়ে যখন নাকের ভেতর ঢোকে, কী মাদকতার অনুভব হৃদয়জুড়ে জাগিয়ে তোলে মনভোলানো অনুভব। প্রকৃতি মা তুমি আসলেই তুলনাহীনা। সূর্যমুখীর তেল সুস্বাস্থ্যের কারিগর, সূর্যমুখীর হাসি সুন্দরের অপার আনন্দ সম্ভার, সূর্যমুখী ফুলের অপ্রকাশিত গোপন মিষ্টিমাখা ঘ্রাণ ব্যাকুল করা হৃদয়গ্রাহী। সূর্যমুখীর ফুল সৌন্দর্যপিপাসুর প্রাণভ্রমরা।

সবচেয়ে অন্য রকম যা হতে পারে সূর্যমুখী আমাদের জীবন সংসারে, তা হচ্ছে শৌখিন সূর্যমুখীর উপস্থিতি রাখা নিজেদের অঙ্গনে। শহর হোক, গ্রাম হোক আমাদের বসবাসকারী বাড়ির উঠানের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায় সমৃদ্ধ আঙিনায় সবখানে অনায়াসে সূর্যমুখীর দু–একটি চারা রোপণ করেও এমন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হতে পারি। মন ভালো হয়ে যাওয়া ফুল আসলেই সূর্যমুখী। আমাদের বসার ঘরে বারান্দায় এমনকি শোবার ঘরে, বাড়ির ছাদের টবে রাখতে পারি সূর্যমুখীর অস্তিত্ব।

সূর্যমুখী আমরা যেখানে যেভাবেই রাখি হয়ে উঠবে সুন্দরের মায়াময় প্রকৃতি, এতটাই সুন্দরের সামর্থ্য আছে এই ফুলটির গতরে। রূপে–গুণে অনন্য এই সূর্যমুখী আমাদের জীবনের পরম প্রাকৃতিক বন্ধু। তাকে ভালোবাসতে জানলে সে তার প্রতিদান দিতে পিছপা হয় না। সূর্যমুখীর গুণ বলেও শেষ করা যাবে না, রূপ বলেও শেষ করা যাবে না। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে অবশ্যই অকৃত্রিম বন্ধু মানুষের, এই সূর্যমুখী।

লেখক: অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক