সেই যন্ত্র ধুলা আরও ওড়ায়

সিটি করপোরেশনগুলোকে ৩০ কোটি টাকায় কিনে দেওয়া হয়েছিল রোড সুইপার। এখন তা তেমন একটা কাজে আসছে না।

সড়কের ধুলা পরিস্কারের জন্য যে রোড সুইপার কেনা হয়েছিল, তা ধুলা আরও ওড়াচ্ছে। ২১ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

রাজধানীর সড়কে ধুলার যন্ত্রণায় যখন মানুষ অতিষ্ঠ, তখন রাস্তা পরিষ্কারের জন্য কেনা রোড সুইপার ট্রাক তেমন একটা ব্যবহার করছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। যন্ত্রগুলো দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিতে গেলে বাতাসে ধুলা আরও বেড়ে যায়। মানুষের তোপের মুখে পড়তে হয় চালকদের।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে গত ২১ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুটি রোড সুইপার দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছিল। সরেজমিনে দেখা যায়, যন্ত্রগুলো ধুলা পরিষ্কারের বদলে উল্টো বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। রোড সুইপার চালিয়ে যাওয়ার পর ধুলা আবার রাস্তায়ই জমা হয়।

ঝাড়ু দেওয়ার আগে রোড সুইপারের সামনে থাকা নল দিয়ে পানি ছিটানোর কথা। কিন্তু পানি ছিটানো হচ্ছে না। কারণ কী, জানতে চাইলে চালকেরা বলেন, পানি ছিটালে ধুলো পরিষ্কার হয় না, উল্টো কাদা তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে রোড সুইপার বন্ধও হয়ে যায়। ধুলাগুলো যন্ত্রের ভেতরে চেম্বারে জমা হওয়ার কথা। যদিও পুরোটা হয় না।

১২টি সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছিল ২০টি রোড সুইপার।পাঁচ মাস আগে ঘটা করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হস্তান্তর। পানি না ছিটালে ধুলা ওড়ে। ছিটালে ধুলো পরিষ্কার হয় না, উল্টো কাদা তৈরি হয়।

সব মিলিয়ে যে উদ্দেশ্যে রোড সুইপার কেনা হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না। কিন্তু জনগণের করের টাকা ঠিকই ব্যয় হয়েছে। মোট ২০টি রোড সুইপার কিনতে খরচ হয় ২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বাজেটের মন্ত্রীর অভিপ্রায় খাত থেকে ‘রোড সুইপার’ কেনার ব্যয় বহন করা হয়। কেনাও হয় স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর ইচ্ছায়। যন্ত্রগুলো আমদানি করা হয় ইতালি থেকে। নিয়ম অনুযায়ী কেনার আগে কার্যকারিতা পরীক্ষার কথা। তবে করোনা মহামারির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

ঘটা করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত বছর অক্টোবরে সিটি করপোরেশনের কাছে রোড সুইপার হস্তান্তর করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি গত ২৩ মার্চ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রোড সুইপার তো কাজ করার কথা। কাজ করছে না, এমন কথা তিনি শোনেননি। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।

করপোরেশনের তিক্ত অভিজ্ঞতা

২০টি রোড সুইপারের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রামকে দেওয়া হয় তিনটি করে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে দুটি করে এবং বাকি ৭টি সিটি করপোরেশনকে একটি করে দেওয়া হয়।

কোনো যন্ত্র কেনার আগে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে হবে তা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু কার্যকর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রোড সুইপারের মাধ্যমে এ দেশের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
আদিল মুহাম্মদ খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দেওয়া তিনটি রোড সুইপারের মধ্যে দুটি নগর ভবন প্রাঙ্গণে ফেলে রাখা হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে। গত ২১ মার্চ গিয়ে দেখা যায়, দুটি রোড সুইপার নগর ভবনের পূর্ব ফটকের সামনে রাখা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রগুলো চালালে ধুলা বেশি ওড়ে। মানুষ বিরক্ত হয়। তাই খুব একটা ব্যবহার করা হয় না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চালকেরা জানালেন, রোড সুইপার চালাতে গিয়ে তাঁদের একজন মারধরের শিকার হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটে চলতি মাসের শুরুতে। ওই চালক ইসলামি ফাউন্ডেশনের ভবনের সামনের সড়ক রোড সুইপার দিয়ে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। এতে চারপাশ ধুলায় ছেয়ে যায়। কয়েকজন যুবক এসে চালককে যন্ত্রটি চালাতে বন্ধ করতে বলেন। এ সময় চালক বলেন, তাঁকে যন্ত্রটি চালাতেই হবে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। এরপর যুবকেরা তাঁকে মারধর করেন।

আগারগাঁওয়ে ওই এলাকায় ভোরে অনেক মানুষ হাঁটতে বের হয়। তাঁদের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেদিন রোড সুইপার চলে, সেদিন ধুলাবালু আরও বেশি ওড়ে।

রোড সুইপার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। নাসিকের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সামনে পানি ছিটিয়ে রোড সুইপার চালাতে হয়। কিন্তু পানি ছিটালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার পানি না ছিটালে প্রচুর ধুলা হয়।

বাকি সিটি করপোরেশনগুলো অভিজ্ঞতাও মোটামুটি একই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করপোরেশনগুলো রোড সুইপার নিয়মিত ব্যবহার করে না। কারও কারও সমস্যা দক্ষ চালক না থাকা। খুলনা সিটি করপোরেশনের কনজারভেন্সি সুপারভাইজার ইন্সপেক্টর তানবিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রোড সুইপার চালানোর ক্ষেত্রে ধুলা ওড়ার সমস্যার মুখে তাঁরাও পড়েছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন-১ শাখার তত্ত্বাবধানে রোড সুইপার যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছিল। তখন এই শাখার দায়িত্বে ছিলেন উপসচিব আ ন ম ফয়জুল হক, যিনি বর্তমানে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের রোড সুইপার কেনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তাঁর দায়িত্ব ছিল। কেনাকাটা বা কারিগরি কোনো কমিটিতে তিনি ছিলেন না।

‘কার্যকারিতা আগে দেখতে হবে’

বাতাসে অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় থাকা শহরের একটি। বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ বলছে, গতকাল সন্ধ্যায় দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে ঢাকা ছিল ২ নম্বরে। শীর্ষে ছিল চীনের বেইজিং। অথচ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে কেনা যন্ত্র কাজে লাগছে না।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো যন্ত্র কেনার আগে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে হবে তা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু কার্যকর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রোড সুইপারের মাধ্যমে এ দেশের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।