সোহরাওয়ার্দীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দশম কিস্তি

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি।
১৯৫৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল গ্রে ব্রিম ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, যুক্তফ্রন্টে নতুন করে চিড় ধরেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর অধ্যাপক কাজী কামারুজ্জামান ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে একটি জ্বালাময়ী বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, মওলানা ভাসানীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পুনরায় শোষণ করার জন্য সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর কোটারি গোষ্ঠী পুনর্বার ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করছে। আওয়ামী মুসলিম লীগে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একজন প্রকৃত নেতা হতে পারেন না। কারণ, তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি সমর্থন করেন না এবং তাঁর ‘সর্ব পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ও সমর্থন করে না। অধ্যাপক কাজী কামারুজ্জামান তাঁর ওই বৃিবতিতে বলেন, এই গ্রুপটি ভাসানীকে পাশ কাটিয়ে যুক্তফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম লীগ তাদের দিয়েই বাঙালির ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।
গ্রে ব্রিমের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ‘কামারুজ্জামানের ওই বিবৃতিকে সমর্থন করে অনেক আওয়ামী লীগার ও সমমনোভাবসম্পন্ন নেতারা বিবৃতি দিয়েছিলেন। ঢাকা শহর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আলী আমজাদ খান তথাকথিত যুক্তফ্রন্টের পর্দার আড়ালে দুরভিসন্ধিপূর্ণ খেলার নিন্দা করেন।
ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল চার্লস ডি উইদার্স তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে সফর সম্পর্কে একটি বার্তা পাঠান। সোহরাওয়ার্দী এ সময় জনসভাগুলোতে বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে বক্তৃতা করেন। উইদার্স লিখেছেন, ‘আমরা অবহিত হয়েছি যে সোহরাওয়ার্দী কার্যত জনতাকে তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কখনো উর্দু, কখনো বাংলায় কথা বলেন। তিনি সমবেত জনতার সকল অংশকে সন্তুষ্ট করতে সফল হয়েছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে সোহরাওয়ার্দী একজন চালাক মানুষ। দুটি বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা তাঁর উদ্ভাবনপটুতার উদাহরণ তৈরি করে। নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে তিনি জনগণকে বলেন, তাঁরা কি জানতেন নিরাপত্তা আইনে কী আছে? এরপর তিনি বলেন, যখন কেউ সরকারের সমালোচনা করে, তখন পুলিশ এগিয়ে আসে এবং বিচার ছাড়াই তাদের কারাগারে প্রেরণ করে। আবার ভাষার ইস্যুতে তিনি মন্তব্য করেন যে উর্দু হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা। এটা শুনে যখন কতিপয় বাঙালি তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেন, তখন তিনি তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রভাষা ছিল কি না। তখন তিনি যুক্তিজাল বিস্তার করেন যে রাষ্ট্রভাষা হবে বাঙালির জন্য বাংলা, পাঞ্জাবিদের জন্য পাঞ্জাবি, সিন্ধিদের জন্য সিন্ধি প্রভৃতি।
ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত একটি পত্রিকার ক্লিপিংয়ে দেখা গেল, সোহরাওয়ার্দী ঢাকার আরমানিটোলা পার্কে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, ‘উর্দুর সঙ্গে বাংলা সর্বত্র পাঠ্য হওয়া উচিত। তাঁর এই উক্তি শুনে শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এবং অনেকেই জনসভা ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। কেউ কেউ চিৎকার করে বলেন, কায়েদে আজম তো ইতিমধ্যে আমাদের বলেছেন, কেবল উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সোহরাওয়ার্দী তখন বলেন, ‘তিনিও কায়েদের সঙ্গে একমত। তবে কথা হলো, কায়েদে যখন যা-ই বলবেন, তা সব সময় সবটুকু সঠিক হতে পারে না। আমরা যা ভাবি সে অনুযায়ী কাজ করার অধিকার আমাদের আছে।’
চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে করাচিতে সোহরাওয়ার্দী একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এ সম্পর্কে করাচির মার্কিন দূতাবাস ১৯৫৪ সালের ২০ মার্চ একটি প্রতিবেদন পাঠান। এতে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী নির্দিষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাকে অবশ্যই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।