স্কুলটা ওদের বড্ড দূরে!

দীঘিনালার চার গ্রামের শিশুরা প্রতিদিন এভাবেই দলবেঁধে বিদ্যালয়ে যায়। ছবি: প্রথম আলো
দীঘিনালার চার গ্রামের শিশুরা প্রতিদিন এভাবেই দলবেঁধে বিদ্যালয়ে যায়। ছবি: প্রথম আলো

স্কুলে যেতে নয় কিলোমিটার, আসতে নয়—সাকল্যে ১৮ কিলোমিটার। ভোর ছয়টায় যাওয়া, ফেরা সেই সন্ধ্যা সাতটায়। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের রথিচন্দ্র কার্বারী পাড়া, জিরক পাড়া, হেমন পাড়া ও নতুন পাড়া গ্রামে কোনো বিদ্যালয় নেই। অগত্যা প্রতিদিন এসব গ্রামের ২৫ জন শিক্ষার্থীকে দল বেঁধে হেঁটে যেতে হয় কাছের নয় মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এসব গ্রামের রেশমী ত্রিপুরা, ববার্ত্তি ত্রিপুরা এ বছর প্রাক্‌-প্রাথমিকে ভর্তি হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে প্রতিদিন প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। এই চার গ্রামে দুই শতাধিক পরিবারের বাস।

৭ মার্চ আটমাইল এলাকার ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ১৩ জন শিক্ষার্থীর একটি দল হেঁটে নয় মাইল দূরে গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে বসে কথা হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। প্রথম শ্রেণির তালিকা ত্রিপুরা, চমইতি ত্রিপুরা ও দিনেশ ত্রিপুরাদের নিত্যদিনের রুটিন একই রকম। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় ঘর থেকে বিদ্যালয়ের উদ্দেশে বের হওয়া। সকাল নয়টার মধ্যে বিদ্যালয়ে পৌঁছানো। বিদ্যালয়ে আসতে তাদের তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়। বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা বেজে যায়।
পঞ্চম শ্রেণির রণজিৎ ত্রিপুরা বলছিল, ‘সকালে বাড়ি থেকে খাবার খেয়ে আসি। দুপুরে কোনো খাবার খাই না। হেঁটে আসতে হয় বলে খাবার আনা বোঝা লাগে।’

শিশুদের এই কষ্ট পীড়া দেয় অভিভাবকদের। তবে কিছু করার নেই। গ্রামের প্রায় সব পরিবারই কৃষিনির্ভর। রথিচন্দ্র কার্বারী পাড়া গ্রামের ললিত কুমার ত্রিপুরা (৪৮) বলছিলেন, ‘বাচ্চারা দুপুরে উপোস থাকে। গ্রামে একটি বিদ্যালয় থাকলে খুব উপকার হতো।’
নয় মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সূর্যশ্বর ত্রিপুরা জানান, এসব এলাকার ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। তাই শিশুদের বাধ্য হয়ে এ স্কুলে আসতে হয়।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) নয়নময় ত্রিপুরা দুর্গম এলাকা লম্বাছড়ার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘দুর্গম এলাকার শিশুরা কী কষ্ট করে পড়াশোনা করে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এত দূরে হেঁটে ছোট ছোট শিশু প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়। দুপুরে যদি খাবার না খায়, তবে শিশুদের মধ্যে পড়াশোনায় অনাগ্রহ, শারীরিক গঠনে সমস্যা, পুষ্টিহীনতা ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
এসব দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিশুদের কষ্ট লাঘব করতে সরকারি উদ্যোগ কতটুকু? উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ঝর্ণা চাকমা বলেন, কয়েকটি গ্রাম নিয়ে যদি দেড় থেকে দুই শ পরিবারের বসবাস থাকে এবং আশপাশে কোনো বিদ্যালয় না থাকে, তাহলে সেখানে বিদ্যালয়বিহীন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এখানে বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা বলেন, ‘আমি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে অন্তত রথিচন্দ্র কার্বারী পাড়া গ্রামে একটি বিদ্যালয় কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা দ্রুত আলোচনা করে ব্যবস্থা নেব।’