স্থায়ী ঠিকানায় জমি-বাড়ি না থাকা চাকরির ‘বাধা নয়’

স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ে ‘নানান উপায়’ রয়েছে। জমি-বাড়ি আছে কি না, শুধু সেটা যাচাই করায় চাকরিবঞ্চিত হচ্ছে মানুষ।

স্থায়ী ঠিকানায় জমি-বাড়ি না থাকায় চাকরি হচ্ছিল না বরিশালের কলেজছাত্রী আসপিয়া ইসলামের। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি চাকরি পানফাইল ছবি

‘ভূমিহীন’ বলে পুলিশে চাকরি আটকে গিয়েছিল বরিশালের কলেজছাত্রী আসপিয়া ইসলামের। তবে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর সম্প্রতি পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে চাকরি হয় তাঁর। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁকে ঘর বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

অনেকেই ভাড়া বাড়িতে থাকেন, ঠিকানাও অনেক সময় বদলাতে হয়। নিজস্ব বাড়িঘর বা জমি না থাকার কারণে চাকরি হওয়া প্রার্থীদের বাদ দেওয়া অন্যায়।
আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

আসপিয়ার চাকরি হলেও স্থায়ী ঠিকানায় নিজস্ব জমি বা বাড়িঘর না থাকায় কোনো কোনো চাকরিপ্রার্থী জটিলতায় পড়ছেন। এ কারণে কারও কারও চাকরি হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

আরও পড়ুন

অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তা এবং সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমন কোনো বিধিবিধান নেই। তাঁদের ভাষ্য, মূল বিষয় হলো, চাকরিপ্রার্থীরা আবেদনপত্রে যে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেন, তাঁরা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু এটি যাচাই করতে গিয়ে পুলিশ ‘সহজ উপায়’ হিসেবে চাকরিপ্রার্থীর নিজস্ব বাড়িঘর বা জায়গাজমি আছে কি না সেটি দেখে, যা একমাত্র উপায় হতে পারে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দেওয়া নাগরিক সনদসহ স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের আরও বিভিন্ন উপায় আছে। তাঁরা এ–ও বলছেন, স্থায়ী ঠিকানায় নিজস্ব বাড়িঘর বা জায়গাজমি না থাকার অজুহাতে চাকরি না দেওয়াটা অন্যায়।

স্থায়ী ঠিকানা প্রমাণের জন্য স্থায়ী স্থাপনা আছে কি না, সেটি খোঁজা হয়। কিন্তু যাঁদের তা নেই, তাঁরা চাকরি পাবেন না, এমন কোনো কথা বলা নেই।
কে এম আলী আজম, জ্যেষ্ঠ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

এ বিষয়ে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান তাঁদের বিদ্যমান নিয়মটি জানাতে গিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কনস্টেবল পর্যায়ের নিয়োগ হয় জেলা কোটার শূন্য পদের ভিত্তিতে। বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগের জন্য ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা মর্মে সনদ থাকতে হয়। এ জন্য স্থায়ীভাবে বসবাসের তথ্য থাকতে হবে অথবা নিবন্ধিত (রেজিস্ট্রিকৃত) জমি থাকলে বলা যাবে তিনি ওই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। আবার এমন হতে পারে আদি বসবাস ওই জেলায় ছিল, কিন্তু নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে এখন কোনো জায়গাজমি নেই। সে ক্ষেত্রে ভূমিহীন ঘোষণা করে স্থায়ী জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সনদ নিতে হয়। তখন তিনি ভূমিহীন হিসেবে চাকরি পেতে পারেন। এর বাইরে অন্য কোনো সুযোগ আছে কি না, সেটি তাঁর জানা নেই।

আরও পড়ুন

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ে জমি-বাড়ি থাকা, না থাকার বিষয়টি সম্প্রতি বেশ আলোচিত হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, এ নিয়ে কী করা যায়, তা তারা ভাবছে। প্রাথমিক ভাবনা হলো, বাড়ি-জমি থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা চিহ্নিত করার জন্য অন্যান্য উপায় বের করার ব্যবস্থা নেওয়া। প্রতিটি উপজেলায় ভূমিহীন কারা, সেই তালিকা সরকারের কাছে আছে। ভূমিহীনের তালিকাটি বিবেচনায় নেওয়ার চিন্তাও চলছে। বিদ্যমান জেলা কোটা নিয়ে বিকল্প চিন্তার সুযোগ থাকলেও মন্ত্রণালয় সেখানে কোনো পরিবর্তন আনতে চায় না। কারণ, এখনো অনেক জেলা পিছিয়ে আছে। কোটা বাদ দিতে গেলে এগিয়ে থাকা জেলার চাকরিপ্রার্থীরা আরও এগিয়ে যাবেন। এতে বৈষম্য বাড়বে।

স্থায়ী ঠিকানায় জমি নেই হাসান সিদ্দিকীর পরিবারের। তাই পাননি পুলিশের চাকরি
ছবি: সংগৃহীত

চাকরির বিধিবিধান বিষয়ে অভিজ্ঞ ও এ বিষয়ে বিভিন্ন বইয়ের লেখক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক দেশের যেকোনো স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার রাখেন। সে জন্য জমি থাকতে হবে, তার কোথাও উল্লেখ নেই। এটি রাষ্ট্র চাপিয়েও দিতে পারে না, বরং যাঁর জমি নেই তাঁকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে জমি দেওয়ার কথা। তিনি বলেন, নিজস্ব জমি বা বাড়িঘর না থাকার কারণের কথা বলে যাঁরা চাকরি হওয়া আটকে দিচ্ছেন, তাঁরা ভুল করছেন। এখানে স্থায়ী বসবাসের সপক্ষে প্রমাণ থাকলেই হলো। এ জন্য ওই এলাকার জনপ্রতিনিধির নাগরিক সনদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ, চারিত্রিক সনদ ইত্যাদির মাধ্যমেই সেটি দেখা যায়।

আরও পড়ুন

ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর যদি সনদ দেন যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উল্লেখিত এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, তাহলেই হলো। নিজস্ব বাড়িঘর বা জায়গাজমি না থাকা স্থায়ী বাসিন্দা চিহ্নিত করার মাপকাঠি হতে পারে না।

জটিলতায় তাঁরা

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস, ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৫ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে ১ম শ্রেণির ১ লাখ ৮৪ হাজারের মতো। দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় পৌনে ২ লাখ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় সাড়ে ১১ লাখ সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। অবশ্য সর্বশেষ বেতনকাঠামোয় সরকারি চাকরিতে শ্রেণিবিভাজন বাতিল করে গ্রেডভিত্তিক কাঠামো করা হয়েছে।

নিয়মানুযায়ী চাকরির আবেদনে অস্থায়ী ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। একসময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা ছিল, এখন নেই। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে এখনো কোটাব্যবস্থা চালু আছে। এগুলোতে জেলা কোটা রয়েছে। পুলিশ কনস্টেবল ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের মতো পদগুলোতে চাকরি হয় এলাকাভিত্তিক (জেলা বা উপজেলা কোটা অনুযায়ী)। পিছিয়ে থাকা জেলা-উপজেলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং নিম্ন পর্যায়ের পদের চাকরিজীবীদের দূর-দূরান্তে চাকরি করার অসুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেই কোটা পদ্ধতিতে নিয়োগ হয়। এতে চাকরি প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানার বিষয়টি দেখা হয়। আবার অন্যান্য পদেও পুলিশি যাচাইয়ে প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানায় খোঁজখবর নেওয়া হয়। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় যাচাইটি হয়, তাতে জটিলতা হয়।

আরও পড়ুন

স্থায়ী ঠিকানায় জায়গাজমি না থাকলে জটিলতাগুলো কেমন হয়, তার একটি উদাহরণ দিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চাকরিজীবী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে কয়েক বছর আগে তাঁর স্ত্রীর চাকরি হয়। তাঁর স্ত্রী সাভারের স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু নিয়োগপত্র দেওয়ার আগে পুলিশ যাচাই বা ভেরিফিকেশনে গিয়ে দেখে যে সাভারে তাঁর স্ত্রী বা পিতার নামে জায়গাজমি নেই। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে আছে। এই নিয়ে জটিলতা হলে পরে তাঁর শাশুড়ি নিজের নামে থাকা জমি মেয়ের নামে লিখে দেন।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে গত ১ জানুয়ারি বলা হয়, ভাড়া বাসায় থাকা সাভারের ‘ভূমিহীন’ হাসান সিদ্দিকীর পুলিশে চাকরি হয়নি। তিনি অনেক চেষ্টার পর স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে ‘ভূমিহীন’ সনদ সংগ্রহ করেন। তবে ততক্ষণে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়। ফলে চাকরিটি তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর নথিপত্র নেওয়া হয়েছে। সেই নথিপত্র পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। হাসান সিদ্দিকী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এখন তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন।

জটিলতার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া গেল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি একটি দপ্তরে এক ব্যক্তি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি পান। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা পাবনায়। তবে সেখানকার জায়গাজমি বিক্রি করে তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীতে থাকে। কিন্তু পুলিশ পাবনায় গিয়ে দেখে সেখানে তাঁদের কোনো বাড়িঘর বা জমি নেই। এরপর রাজশাহীতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, সেখানেও ওই প্রার্থীর পরিবারের নিজস্ব জমি নেই। তাঁরা প্রথমে সরকারি আবাসনে (কোয়ার্টার) থাকতেন। পরে ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। পুলিশের এই প্রতিবেদনে ওই প্রার্থীর চাকরি আটকে যায়। অবশ্য এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক মত দেয়, যা ওই চাকরিপ্রার্থীর পক্ষে যায়।

যা বলছে মন্ত্রণালয়

স্থায়ী বাসিন্দা হতে হলে স্থায়ী স্থাপনা বা ঘরবাড়ি থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম কোনো কিছু নেই। প্রার্থী দেশের নাগরিক কি না, নাগরিকের সংজ্ঞা যদি পূরণ হয়, তাহলেই চাকরির জন্য যোগ্য হবেন। তবে স্থায়ী ঠিকানা প্রমাণের জন্য স্থায়ী স্থাপনা আছে কি না, সেটি খোঁজা হয়। কিন্তু যাঁদের তা নেই, তাঁরা চাকরি পাবেন না, এমন কোনো কথা বলা নেই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, এখানে একটি বিষয় একেবারেই পরিষ্কার, সেটি হলো প্রার্থী যে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন, তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া। এর সঙ্গে নিজস্ব বাড়িঘর থাকা বা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও বাস্তবতা হলো, পুলিশ যখন যাচাই (ভেরিফিকেশন) করতে যায়, তখন ব্যক্তি স্থায়ী বাসিন্দা কি না, তা চিহ্নিত করতে সহজ উপায় হিসেবে বাড়িঘর বা জমিজমা আছে কি না, সেটিই মুখ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করে। ফলে জটিলতাগুলো হয়।

আরও পড়ুন

‘বাদ দেওয়া অন্যায়’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ে কী কী বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, তা স্পষ্ট করে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া দরকার। কারও সমস্যা নিয়ে আলোচনা তৈরি হলে তিনি চাকরি পাবেন, আর যার ক্ষেত্রে আলোচনা তৈরি হবে না, তিনি চাকরি পাবেন না—এটা কাম্য নয়।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারও উল্লেখ করেন, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমি বা বাড়ি থাকতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বহু মানুষ আছেন যাঁদের নিজস্ব জমি বা বাড়িঘর নেই। অনেকেই ভাড়া বাড়িতে থাকেন, ঠিকানাও অনেক সময় বদলাতে হয়। নিজস্ব বাড়িঘর বা জমি না থাকার কারণে চাকরি হওয়া প্রার্থীদের বাদ দেওয়া অন্যায়। মূলত দেখতে হবে চাকরি প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা সঠিক কি না। এখানে জায়গাজমি আছে কি না, এগুলো দেখার বিষয় নয়।