স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আছেন মাঠকর্মীরা

স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যের পেছনে সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মীদের বিশাল ভূমিকা আছে। কিন্তু তাঁদের স্বীকৃতিতে কার্পণ্য দেখা যায়।

গ্রামীণ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি সেবা মানুষের ঘরে পৌঁছে দেন মাঠকর্মীরা। সরকারি-বেসরকারি প্রায় তিন লাখ কর্মী এই কাজে যুক্ত। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তবে তাঁদের স্বীকৃতির ব্যাপারে কার্পণ্য চোখে পড়ে।

শহরে স্বাস্থ্য মাঠকর্মীদের খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু গ্রামের রাস্তায়, হাটে-বাজারে তাঁদের দেখা যায়। তাঁদের অধিকাংশ কর্ম এলাকারই বাসিন্দা। তাঁরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যান। তাঁরা আত্মীয়ের মতো মানুষের ঘরে যান, মানুষকে সেবা দেন, স্বাস্থ্যসচেতন করেন, ভালো থাকার পরামর্শ দেন।

দুঃখের বিষয়, এই মহামারির সময় তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানো হলো না। মহামারি নিয়ন্ত্রণের কাজে তাঁদের সম্পৃক্ত করা হলে পরিস্থিতি আরও ভালো হতে পারত।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য মাঠকর্মী বা কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কাররা সারা দেশে কাজ করছেন। সরকারি পর্যায়ে রয়েছে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবারকল্যাণ সহকারী, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভলান্টিয়ার, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। কমিউনিটি ক্লিনিককে ঘিরে সরকার সম্প্রতি মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার নিয়োগ শুরু করেছে, তাঁরাও মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কর্মী আছে। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্র্যাকের ‘স্বাস্থ্য সেবিকা’। ২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে চিকিৎসা ও বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট বলেছিল, জনসংখ্যার অনুপাতে ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মাঠকর্মীর সংখ্যা বেশি।

মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যেসব দেশ বিশেষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছিল, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই কাজ শুরু হয়েছিল গত শতকের ষাটের দশকে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কাজের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর এই কাজ হয়েছিল আরও সুসংগঠিতভাবে।

তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতিতে অবশ্যই মাঠকর্মীদের বড় ভূমিকা আছে। তবে সরকারের নীতি, পরিকল্পনা, সহায়তা, নজরদারি ছাড়া সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাঁদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।

আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

কী কাজ তাঁদের

স্বাস্থ্য মাঠকর্মী বা কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের ধারণাটি আসে মূলত চীন থেকে, গত শতকের বিশের দশকে। তাঁদের বলা হতো ‘বেয়ার ফুট ডক্টরস’ বা নগ্ন পায়ের চিকিৎসক। তাঁদের কাজের পরিধি ছিল সীমিত ও সুনির্দিষ্ট। শুরুর দিকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করাই ছিল তাঁদের কাজ। পরে কাজের পরিধি বাড়ে।

চীনের এই উদ্ভাবন ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা সম্মেলনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মাঠকর্মীদের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক জনপদ, গ্রাম এবং মাঠকর্মীরা এখন স্বাস্থ্যসচেতনতা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি সেবা, পুনর্বাসন সেবা দেন। কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা ‘ফাস্ট এইড’ও দেন। এখন ভাবা হচ্ছে, অসংক্রামক (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি) রোগ নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করা এবং সাধারণ ও সহজ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁদের কাজে লাগাতে হবে।

তাঁরা মাঠে ছিলেন, তাই...

মাঠকর্মীদের কাজে লাগিয়ে জাতীয় কর্মকাণ্ডকে সফল করে তোলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি। মাঠকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন, হাতে তুলে দিয়েছেন জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী। দেশের মানুষকে পরিবার ছোট রাখায় অভ্যস্ত করে তুলেছেন। স্বাধীনতাকালে একজন মা গড়ে ছয়টির বেশি সন্তান জন্ম দিতেন, এখন সেই সংখ্যা কমে প্রায় দুইয়ে নেমে এসেছে।

দেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। তখন টিকা দেওয়া হতো জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে। এনজিও মাঠকর্মীদের যুক্ত করে ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু হয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি। শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে বিশ্বে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে।

বেসরকারি মাঠকর্মী

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে সরকারের পাশে দাঁড়ায় দেশি-বিদেশি অনেক এনজিও। এদের কাজের নীতিসহায়তা দিয়েছিল সরকার। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে শত শত এনজিও কাজে নেমে পড়ে।

একটি হিসাব বলছে, ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোতে নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৫২। তবে দেশে তখন নানা ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার, এর মধ্যে ৪ হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির পর বেশিসংখ্যক এনজিও যুক্ত ছিল স্বাস্থ্য খাতে।

স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে ব্র্যাক প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের কেন্দ্রে রেখে স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু করে। ২০১১ সাল নাগাদ দেশের ৬৪ জেলার গ্রামে গ্রামে ব্র্যাকের ৯১ হাজার স্বাস্থ্য সেবিকা কাজ করতেন। শুধু যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সঙ্গে ব্র্যাকসহ ৪০টি এনজিও কাজ করছে।

চ্যালেঞ্জ

সরকার সৃজনশীলভাবে স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিতে মাঠকর্মীদের কাজে লাগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে তারা। পাশাপাশি দেশের গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগিয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) চাঁদপুরের মতলবে দেখার চেষ্টা করেছিল মাঠকর্মীদের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। তাদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার সারা দেশে মাতৃ ও শিশু কর্মসূচিতে সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মীদের যুক্ত করে।

স্বাস্থ্য খাতে মাঠকর্মীদের অবদানের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে মাঠকর্মীদের বিশাল অবদান রয়েছে। তাঁদের অভিজ্ঞতাও তুলনাহীন। দুঃখের বিষয়, এই মহামারির সময় মাঠকর্মীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানো হলো না। মহামারি নিয়ন্ত্রণের কাজে তাঁদের সম্পৃক্ত করা হলে পরিস্থিতি আরও ভালো হতে পারত।’