স্বাস্থ্যখাতে অগ্রযাত্রার ৫০: আজ পর্ব—৪২
স্বাস্থ্যে বড় অবদান ব্র্যাকের
৫০ বছর মানুষের জন্য কাজ করছে ব্র্যাক। যাদের জন্য কাজ করছে, তাদের স্বাস্থ্যকে মূল্য দেয় ব্র্যাক।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজের মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক। শুরুতে (১৯৭২-৭৩) এর নাম ছিল বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি। পরে (১৯৭৩-৯৪) নাম হয় বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি। ফজলে হাসান আবেদ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল দাতাদের আর্থিক সহায়তায় ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। গত পাঁচ দশকে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে দেশের প্রায় ১১ কোটি মানুষ।
শুরুর দিকেই ব্র্যাকের নীতিনির্ধারকেরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক বা প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগগুলো বাধাগ্রস্ত হয় মানুষের রোগগ্রস্ততা বা চিকিৎসাজনিত সমস্যার কারণে। সুতরাং, যাদের জন্য কাজ করা, তাদের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয় ব্র্যাক। চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সরকারের অংশীদার হয়ে কাজ করে যাব। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে সরকারকে সহায়তা করব আমরা। এসডিজির স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্র্যাকের কাজ অব্যাহত থাকবে।ড. মোর্শেদা চৌধুরী পরিচালক, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি, ব্র্যাক
জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে গত ৫০ বছর লাগাতারভাবে ছোট-বড় নানা ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। স্বাস্থ্য খাতে ব্র্যাকের উজ্জ্বল উপস্থিতি তার স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির কারণে। সারা দেশে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও স্তন্যদানকারী মা, কিশোরী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং প্রতিবন্ধী। তবে অগ্রাধিকার পেয়েছে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানুষ।
ব্র্যাক মডেল
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের আছে নানা ধরনের উদ্ভাবন। মাঠে কাজের সমস্যা দেখা দিলে তা সৃজনশীলভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে তারা। নতুন পন্থা প্রথমে ছোট পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সফল বলে প্রমাণিত হলে তা তাদের কর্ম এলাকায় বাস্তবায়ন করেছে।
ব্র্যাক জনস্বাস্থ্যের কাজকে উন্নয়নকাজের সঙ্গে যুক্ত করার শুরুতে সুনামগঞ্জের শাল্লাতে চারটি ক্লিনিক চালু করে। চিকিৎসকের সঙ্গে ক্লিনিকে কাজ করতেন পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্যকর্মীরা ছোটখাটো রোগের চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু কর্মসূচি সফল হয়নি। মূল্যায়নে দেখা গিয়েছিল, পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীরা মাতৃস্বাস্থ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত নন। শাল্লার অভিজ্ঞতা থেকে এবং চীনের ‘নগ্ন পায়ের চিকিৎসক’ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা থেকে ব্র্যাক মাঠপর্যায়ে নারী স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্র্যাকের আছে মাঠপর্যায়ে দুই ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী বা কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার: স্বাস্থ্য সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মী।
গ্রাম এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় থাকা পরিবার থেকে স্বাস্থ্য সেবিকা বেছে নেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও স্বাস্থ্যশিক্ষার কর্মসূচির একটি যোগসূত্র তৈরি হয়। স্বাস্থ্য সেবিকারা প্রশিক্ষণ পাওয়া। একজন স্বাস্থ্য সেবিকা ৫০০টি খানার দায়িত্বে। তাঁরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি খানায় যান। তাঁরা পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেন, টিকা দেওয়ায় সহায়তা করেন। আছে আরও নানা স্বাস্থ্যসেবা। সারা দেশে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
স্বাস্থ্য সেবিকাদের কাজের তদারকি করেন স্বাস্থ্যকর্মী। সারা দেশে তাঁদের সংখ্যা পাঁচ হাজার।
স্বাস্থ্য সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খাওয়ার স্যালাইনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হওয়ার পর তা মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া বা তার ব্যবহার বাড়ানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তা সম্ভব ছিল না। এটা সম্ভব করে তুলেছিলেন ব্র্যাকের কর্মীরা। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা খাওয়ার স্যালাইনের গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন, প্রায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন। আধা সের বিশুদ্ধ পানি, এক চিমটি লবণ ও এক মুঠ গুড় দিয়ে তৈরি স্যালাইন লাখ লাখ মানুষকে ডায়রিয়াজনিত রোগ থেকে রক্ষা করেছে। স্যালাইন খাওয়া এখন এ দেশের মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে ব্র্যাকের অবদান অনেক বড়।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ডটসের (ডিরেক্টলি অবজার্ভড থেরাপি, শর্ট-কোর্স) মাধ্যমে রোগীদের ওষুধ সেবন করানোর কথা। নিয়মিত সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধ সেবন করা নিশ্চিত করতে এই ডটস। ব্র্যাকের কর্মীদের প্রতিদিন যক্ষ্মারোগীর বাড়িতে যেতে হয়, দেখতে হয় রোগী নিয়মিত ঠিক মাত্রায় যক্ষ্মার ওষুধ সেবন করছেন কি না। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে মানিকগঞ্জে ব্র্যাকই প্রথম কমিউনিটিভিত্তিক যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের দিশারি প্রকল্প শুরু করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সবচেয়ে বড় অংশীদার ব্র্যাক।
ছিল বড় বড় কর্মসূচি
গত শতকের আশির দশকে সারা দেশে খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা ছিল ব্র্যাকের অন্যতম বড় কাজ। ১৯৮৬ সালে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ শুরু করে ব্র্যাক। একই সময়ে শুরু করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি। খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার বৃদ্ধি, টিকাদান, ভিটামিন এ, কৃমি নাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি করা ছিল মূল লক্ষ্য। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ দাই তৈরি করে নিরাপদ প্রসবসেবায় যুক্ত হওয়াও ছিল ব্র্যাকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
নব্বইয়ের দশকে নারীস্বাস্থ্য কর্মসূচি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, পুষ্টি কর্মসূচির মতো অনেক কর্মসূচি হাতে নেয় ব্র্যাক। এর কোনোটি ছিল জাতীয়ভিত্তিক, কিছু ছিল অঞ্চলভিত্তিক। এরপর মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) সঙ্গে সংগতি রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে ব্র্যাক। মানুষের স্বাস্থ্য যে বিশুদ্ধ পানি ও যথাযথ পয়োব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়, এটা মনে রেখে ব্র্যাক বহু বছর ধরে ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই কর্মসূচির আওতায় ৫৬টি জেলার ২৮৯ উপজেলা ও ১৮৪টি পৌরসভার চার কোটির বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে পারছে। আর নিরাপদ পানীয় জল পাচ্ছে ২৭ লাখের বেশি মানুষ।
ব্র্যাকের প্রতিটি উদ্যোগ সরকারের স্বাস্থ্য কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। সর্বশেষ এই করোনা মহামারিকালেও মানুষকে সচেতন করা, রোগনির্ণয়, মাস্ক বিতরণ, গবেষণাসহ নানা কাজে ব্র্যাক সক্রিয় থেকেছে, যুক্ত থেকেছে।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে এখন নিয়মিতভাবে যুক্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথকে। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠানটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীরা ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচি থেকে হাতে-কলমে শিখতে পারছে। অন্যদিকে ব্র্যাকের কর্মসূচি নিয়মিত মূল্যায়ন করছেন স্কুলের গবেষকেরা। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলের সুনাম কুড়িয়েছে।
৫০ বছর আগের বাংলাদেশ এখন নেই। স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা বদলেছে। রোগের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। ব্র্যাকও বদলাচ্ছে। ব্র্যাক তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের জ্ঞান বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলায় জোর দিয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক ড. মোর্শেদা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের অংশীদার হয়ে কাজ করে যাব। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে সরকারকে সহায়তা করব আমরা। এসডিজির স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্র্যাকের কাজ অব্যাহত থাকবে।’