মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কি.মি.

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাউন্সিলের সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সভা শেষে সিদ্ধান্ত পড়ে শোনান। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকেই গৎবাঁধা কতগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং একই সিদ্ধান্ত বারবার নেওয়া হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গতকালের বৈঠকে মন্ত্রী, ঢাকার দুই মেয়র, সরকারের বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
মহাসড়কে নতুন করে গতিসীমা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হলেও মোটরযান আইনে সব ধরনের যানবাহনের জন্য তা ঠিক করে দেওয়া আছে। আইন অনুযায়ী মহাসড়কে হালকা মোটরযান ও মোটরসাইকেল চলতে পারবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে। বাস-মিনিবাসের সর্বোচ্চ গতি ঠিক করা আছে ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার। আর ভারী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ মালবাহী যানবাহনের গতিসীমা ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
ডিজেলচালিত মোটরযানে (মূলত বাস-ট্রাক) স্পিড গভর্নর নামে একটি যন্ত্র থাকে। এতে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকলে চালক ইচ্ছা করলেও নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে যানবাহন চালাতে পারবেন না। দেশে পেট্রল ও সিএনজিচালিত যান বেড়ে যাওয়ার কারণে এই ব্যবস্থা এখন প্রায় অকার্যকর।
গতকালের বৈঠকে কাউন্সিলের সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কত শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু বৈঠকের আলোচনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। দরকার নেই এমন আলোচনা করে সময় নষ্ট করা হয়। এর ফলে আসল কাজ হয় না। তিনি বলেন, ট্রাকে বেশি মাল বহন করা হচ্ছে কি না, তা মাপার জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানো হয়েছে। অথচ ট্রাকের চেসিসের আকৃতি পরিবর্তন করে কীভাবে ফিটনেস পাচ্ছে, এটা দেখা হয় না। এভাবে চললে প্রকল্প বাড়বে, কাজ হবে না।
বৈঠকে ঈদুল আজহার আগে গাবতলী সেতুর ‘ইউ লুপ’ প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়। গত বছর ঈদের আগেও একই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। মহাসড়কের পাশে পশুর হাট বসতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তও গত বছরের। এরপরও গত ঈদুল আজহায় অনেক স্থানে হাট বসে।
সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। সে সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রতি দুই মাস পরপর কাউন্সিলের বৈঠক হবে। এবার হয়েছে প্রায় আট মাস পরে এবং বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এটি পুনরায় আলোচনার জন্য রাখা হয়। বিভিন্ন বক্তা আবারও সেটি স্মরণ করিয়ে দেন।
এ ছাড়া ঢাকায় যত্রতত্র বাস থামানো বন্ধে বাস বে নির্মাণ, শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়ন করা, মহাসড়কের ওপর থেকে অবৈধ হাটবাজার উচ্ছেদ, ফুটপাত থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ—এসব বিষয়ে আগের বৈঠকে সিদ্ধান্ত ছিল। এবারও বেশির ভাগ সময়জুড়ে আলোচনা হয়েছে এগুলো নিয়েই।
বৈঠকে ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেক কিছু ইচ্ছা করলেই পারা যায় না। রাজনৈতিক নেতারা থাকেন, আলোচনা লম্বা হয়। তিনি জানান, এবার মহাসড়কে ধীরগতির তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে এবং ফিটনেসবিহীন যান ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের বিরুদ্ধে অভিযান কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান পুলিশের সংরক্ষণ করা তথ্যের বরাত দিয়ে বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিমাণ কমেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯২টি দেশের মধ্যে ৯০তম। ভারতেও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
অবশ্য বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসাব দেয়, তাতে পুলিশের হিসাবের চেয়ে হতাহতের পরিমাণ চার গুণ বেশি। আর ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় আট গুণ। ওই দেশের আয়তন ও যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশ খুবই নগণ্য।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, চালকেরা খুবই বেপরোয়া। তাঁদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ঠিক করে দেওয়া উচিত।
চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে সর্বোচ্চ গতিসীমা কিংবা সংকেতও বুঝতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।
এর বিরোধিতা করেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। তাঁরা বলেন, নিরক্ষর চালকেরা বিদেশে গিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক জানান, রাজধানী থেকে শিগগিরই অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ করা হবে। তেজগাঁও বাস টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে কঠোর হবেন তিনি।
ঈদুল আজহার আগে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করার আগে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।
সভায় আরও বক্তৃতা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান, সড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রমুখ।