হঠাৎ এক ভোরে ৩০০ হাঁসের মৃত্যু, মালিকের দাবি খুন, অতঃপর...

খাকি ক্যাম্পবেল জাতের ৩০০ হাঁস হঠাৎ এক সকালে মারা পড়ে
প্রতীকী ছবি

আলমগীর রেজার এখনো বিশ্বাস, তাঁর হাঁসগুলো খুন হয়েছে। একটি-দুটি নয়, ৩০০ হাঁস। পুলিশের তদন্ত, চিকিৎসকের সনদ—কোনো কিছুতেই ঠিক আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি। যে যা-ই বলুক, তিনি নিশ্চিত, কাজটা দুষ্কৃতকারীদের। শত্রুতা করে তারাই বোবা পাখিগুলোকে খুন করেছে।

যদিও পশু চিকিৎসক ও পুলিশের বক্তব্য আলাদা। নীলফামারী সদর থানার পুলিশ ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, মামলার এজাহারে তথ্যগত ভুল আছে। আলমগীর নারাজি দিয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্বও দিয়েছিল। তারাও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

আলমগীর রেজা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাঁসের খামার বেশ পুরোনো। আগে ঘরের কাছেই রাখতেন ওদের। এখন খামার বড় হয়েছে। এত হাঁসের সংকুলান হয় না। তাই নিজেদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের সতাল রায়ের জমি ভাড়া নিয়েছিলেন। জায়গাটা জলাভূমির মতো। স্থানীয়ভাবে এর নাম নাদিয়ার দোলা। ওখানেই অস্থায়ী ঘর তুলে ২ হাজার ৭০০ হাঁসের থাকার ব্যবস্থা করেন। গত বছরের ৮ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কয়েকজন তাঁদের খামারে আসে। এসেই বলে ২০টি হাঁস চাঁদা না দিলে খামার গুটাতে হবে। হাঁস পালায় তাদের নাকি মাছ ধরতে অসুবিধা হচ্ছে। সে কারণে খাইখরচা চাই।

আলমগীর চাঁদা দিতে রাজি হননি। এতে দুর্বৃত্তরা হাঁস মেরে ফেলার হুমকি দেয়। হঠাৎ গত ১১ জুন ভোরবেলা আলমগীর হাঁসগুলোর চিৎকার শুনতে পান। কাছে গিয়ে দেখেন ভীষণ অস্থির তারা। ছটফট করতে করতে তাঁর চোখের সামনেই একে একে সব হাঁস লুটিয়ে পড়তে থাকে। দেরি না করে হাঁসগুলো নিয়ে দ্রুত তিনি নীলফামারী সদর পশু হাসপাতালে যান। চিকিৎসক বলেন, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে সেগুলোর। জীবিতগুলোর জন্য তিনি একটা ওষুধও লিখে দেন। ওষুধও খাওয়ান তিনি। কিন্তু তার আগেই ৩০০ হাঁস মারা যায় আলমগীরের। হুমকি দেওয়ার দুদিনের মাথায় এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারেন না। আলমগীরের বাবা শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে নীলফামারী থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি লেখেন, হাঁসগুলোর মৃত্যুতে তাঁর ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এলাকার লোকজন অবশ্য বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আলমগীর রেজারা অনড়। একে আর্থিক ক্ষতি, তারপর হাঁসের জন্য মায়া, সব মিলেই তাঁরা আদালতে দৌড়ান। আলমগীর জানান, ২০০৮ সালের আগে তাঁরা একবার ব্রয়লার মুরগির চাষ শুরু করেছিলেন। প্রথম দফায় ৬০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন, পরেরবার ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি। মুরগির খামারটা আর দাঁড়ালই না। তখনই তাঁরা মুরগি থেকে হাঁসের দিকে ঝোঁকেন। বরাবর লাভই করে আসছেন। হঠাৎ ধাক্কা খাওয়ায় মনে ভয়, এবার যদি হাঁসের ব্যবসাও গুটাতে হয়!

নাদিয়ার দোলায় আলমগীরদের হাঁসগুলো খাকি ক্যাম্পবেল জাতের। পাতিহাঁস, চীনা হাঁস আর রাজহাঁসের বাইরেও দেশে এখন বিদেশি প্রজাতির হাঁসও পালছেন খামারিরা। খাকি ক্যাম্পবেল, জিংডিং, ইন্ডিয়ান রানার, পিকিং, মাসকোভি—এগুলোই বেশি। আলমগীর, তাঁর ছোট ভাই ও খামারের কয়েকজন কর্মী এক দিন বয়স থেকে ছানাগুলোর দেখাশোনা করছেন। ২২ দিন পর্যন্ত কিছুতেই যেন ঘর থেকে বের না হয়, সে খেয়াল রেখেছেন। যে কক্ষে রেখেছেন, সেটার তাপমাত্রা ঠিক আছে কি না, যে খাবারটা খাওয়াচ্ছেন, সেটা পরিমাণমতো কি না, এমন অনেক কিছুরই খেয়াল রাখতে হয়েছে। এরপর যখন তারা ছাড়া পেল, তখনো সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখতে হয়েছে। তারাও প্রতিদান দিয়েছে।

আলমগীর জানান, তাঁর খাকি ক্যাম্পবেল ছয় মাস বয়স থেকে টানা ১৮০ দিন ডিম পেড়েছে, দুই সপ্তাহর বিরতি দিয়ে আবারও টানা ১৮০ দিন। কিছু হাঁস ডিমের জন্য রেখে কিছু বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তা-ই করে আসছেন। এবার তাঁদের বিনিয়োগ ছিল নয় লাখ টাকা। এর মধ্যে লক্ষাধিক টাকা বেরিয়ে গেল হাঁসগুলোর মৃত্যুর কারণে।

হাঁসের খামারি যদিও দুর্বৃত্তদের দায়ী করছেন, পুলিশ তা মানতে রাজি নয়। নীলফামারী থানা আগেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। থানা-পুলিশ কথা বলেছিল চিকিৎসক শ্যামল কুমার রায়ের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদনে লিখেছেন, হাঁসগুলো তাঁর কাছে এসেছিল স্নায়বিক দুর্বলতা নিয়ে। ওরা ডানা ও পা নাড়তে পারছিল না। মাথা নুয়ে পড়ছিল বারবার। তাঁর ধারণা, ক্ষট্রিডিয়াম বটিউলিজম নামের ব্যাকটেরিয়া থেকে যে টক্সিন তৈরি হয়, তাতেই বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটেছে। জলাশয়ে পচনশীল কিছু ছিল; তা খেয়েই বটিউলিজম রোগে আক্রান্ত হয়েছিল তারা।

হাঁসগুলোর কি ময়নাতদন্ত হয়েছিল? জানতে কথা হয় শ্যামল কুমার রায়ের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হয় না কেউ বিষ দিয়ে খুন করেছে ওদের। তাই আর ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয়নি। ওরা বলছে কীটনাশক। অত বড় জায়গায় কীটনাশক অনেকটা লাগত। আর তাতে শুধু হাঁস নয়, মাছ–ব্যাঙও মারা পড়ত। তেমনটা হয়নি।’

মূলত চিকিৎসকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নীলফামারী থানার পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। আলমগীর ও তাঁর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করেনি। যেদিন সকালে হাঁসগুলো মারা যায়, তার আগের রাতে দুষ্কৃতকারীদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল। সাক্ষীও ছিল। পুলিশ তাদের সবার সঙ্গে কথা বলেনি। তাই তাঁরা আবারও আদালতে যান। তাঁরা নারাজি দেন।

পুলিশ অবশ্য বলেছে, তদন্তে যা যা করা দরকার, সবটাই করেছে তারা। আদালতের নির্দেশে এবার হাঁসের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পায় রংপুরের পিবিআই পরিদর্শক মাসুদ আল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকের সনদের ভিত্তিতে তাঁরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। হাঁসগুলো যেদিন মারা যায়, তার আগের দিন খামারের আশপাশে কারও সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির প্রমাণও তিনি পাননি। সব বিবেচনায় সম্প্রতি আদালতে তাঁরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর করে আলমগীর চাষবাস নিয়েই আছেন। মনে কষ্ট পেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মুরব্বিরা মিটমাট করে নিতে বলেছেন। তাঁরা আপস–রফায় বসেওছিলেন। কিন্তু ভয় কাটেনি মনের। নাদিয়ার দোলা থেকে হাঁস নিয়ে কাঞ্চনের বিলে চলে এসেছেন। প্রতিবছর তিন দফায় হাঁস তোলেন। ভয়ে এবার মাত্র একবার তুলেছেন।