হঠাৎ ভাতা বন্ধ ১৭ হাজারের

কর্মকর্তারা বলছেন, যাচাই-বাছাইয়ে যাঁদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন এসেছে, তাঁদের ভাতার তালিকা থেকে আপাতত বাদ দেওয়া হয়েছে।

■ দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার।

■ জানুয়ারি মাসে ভাতা পাঠানো হয় ২ লাখ ৪ হাজার ১৩ জনের নামে।

■ ফেব্রুয়ারি মাসে ভাতা পাঠানো হয় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৩১ জনের নামে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

হঠাৎ ১৭ হাজার ২৮২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মাসিক ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ভাতা বন্ধের আগে তাঁদের কাউকেই বিষয়টি জানানো হয়নি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ভাতা তুলতে ব্যাংকে গিয়ে বিষয়টি তাঁরা জানতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কর্মকর্তারা বলছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। যাচাই-বাছাইয়ে যাঁদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন এসেছে, তাঁদের ভাতার তালিকা থেকে আপাতত বাদ দেওয়া হয়েছে।

মূলত ২০০১-০৯ সালের মধ্যে যাঁদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তাঁদের একটি অংশের ব্যাংক হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাসের ভাতা যায়নি। উল্লেখ্য, ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। এরপর প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই–বাছাইয়ের পর যাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হননি, তাঁদের ভাতার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণের জন্য তাঁরা যেসব সনদ ও প্রমাণক
জমা দিয়েছিলেন, তার কোনো কোনোটায় সমস্যা আছে। এখন তাঁদের আপিল করতে হবে জামুকায়। তবে কেউ যদি সঠিক তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেন তাহলে আপিল ছাড়াও তাঁর ভাতা আবার চালু হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ও তালিকা প্রণয়নের কাজটি জামুকার মাধ্যমে হয়। তবে জামুকা আইন ২০০২ সালে হলেও ২০১০ সালের আগে জামুকার কার্যক্রম শুরু হয়নি।

বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

ভাতার তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লার মুরাদনগরের মো. আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নাম গেজেটে আছে, লাল মুক্তিবার্তায় আছে, তারপরও ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ভাতা বন্ধ। একবার নাম বাদ দেয়, এর বিরুদ্ধে আপিল করি, তারপর আবার নাম যুক্ত করে। কয়েক বছর ধরে এসবই চলছে। এত বছর পরও কাজটি সুশৃঙ্খলভাবে করতে পারবে না যাচাই-বাছাই কমিটি।’

রাজশাহী মহানগরের ১২৬ জনের ভাতা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছেন ন্যাপ নেতা রুহুল আমিন প্রামাণিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করেছি কি করি নাই, তা আমার সহযোদ্ধারা ভালো জানেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটি অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের অপছন্দের লোকদের বাদ দিয়েছে।’

এক সপ্তাহ ধরে জামুকা কার্যালয়ে ভিড় করছেন ভাতা না পাওয়া ব্যক্তিরা। তাঁদের বেশির ভাগের প্রশ্ন, ঠিক কী কারণে হঠাৎ তাঁদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেটি স্পষ্ট করে বলছেন না জামুকার কর্মকর্তারা। গত বুধবার জামুকা কার্যালয়ে কথা হয় গোপালগঞ্জ সদর এলাকার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়েব আলী মোল্লার ছেলে রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করছেন। রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাচাই–বাছাইয়ে কোনো সমস্যা না থাকার পরও বাবার ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর নাম এখন তালিকায় না থাকলে আমারও চাকরিতে সমস্যা হবে। আমি ১৭ বার জামুকায় এসেছি। আমার চাচা শহিদুল ইসলামও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাতাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু লোকের অবহেলার জন্য এসব হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার। তবে গত জানুয়ারি মাসে ভাতা পাঠানো হয় ২ লাখ ৪ হাজার ১৩ জনের নামে। যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়ায় ফেব্রুয়ারি মাসে সংখ্যাটি কমে হয় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৩১। আগে দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাঠানো তালিকার ভিত্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মাসিক ভাতা পাঠানো হতো। কিন্তু ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে এমআইএসের (মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা এমআইএস নামে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করেছে) তালিকা অনুযায়ী ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি ভাতা পাঠানো হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা মনে করেন, ১৭ হাজার ২৮২ জনের মধ্যে সবার নাম যাচাই-বাছাইয়ে হয়তো বাদ পড়েনি। সফটওয়্যারের কারিগরি ত্রুটির কারণেও অনেকে বাদ পড়তে পারেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কারও নাম গেজেটভুক্তির জন্য ৩৩ ধরনের প্রমাণকের প্রয়োজন। এর মধ্যে জামুকার সুপারিশ অন্যতম। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যাঁদের ব্যাংক হিসাবে ভাতা যায়নি, তাঁদের মধ্যে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ৭৬ জন রয়েছে। তাঁদের ব্যাপারে জামুকার সুপারিশ ছিল না। তবে গত বছর যাচাই-বাছাই শেষে ৬৩ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নিয়মিতকরণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করা যাবে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও ভাতা এভাবে বারবার বাদ দিয়ে আবার যুক্ত করে অসম্মান করা হচ্ছে। যাঁদের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে, তাঁরা যদি যৌক্তিক কাগজপত্র দেখাতে পারেন, তাঁদের আবেদন অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তবে জামুকার সুপারিশ ছাড়া যাঁদের নাম বিভিন্ন সময় সরকারি গেজেটে এসেছে, সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের পর যদি দেখা যায় তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত নন, তাহলে ভাতা বাতিল করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা থাকবে—এটি জাতি আশা করে।