হত্যার রাজনীতি, লাশের মিছিল

নির্বাচনের বছরে নিহতের সংখ্যা
নির্বাচনের বছরে নিহতের সংখ্যা

দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ২২ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজার ৫১৯ জন মানুষ। আর একই সময়ে কম-বেশি আহত হয়েছেন দেড় লাখ মানুষ।

রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচনী সহিংসতা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে, বিরোধী দলে থাকার সময় রাজনৈতিক দলগুলো হরতালসহ নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারাই হরতালের বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার থাকে।

রাজনৈতিক সহিংসতা: ২২ বছরে প্রাণহানি ২৫১৯
রাজনৈতিক সহিংসতা: ২২ বছরে প্রাণহানি ২৫১৯

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই সংখ্যা তো ভয়াবহ। যে মানুষগুলো মারা গেলেন কিংবা যে লক্ষাধিক মানুষ আহত হলেন, কে তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছে? এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। রাজনৈতিক এই সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন দুই হাজার ২৩৪ জন। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ২৩৩, ২০০০ সালে ২০৮, ২০০১ সালে ৫০০, ২০০২ সালে ৩১০, ২০০৩ সালে ২০৩, ২০০৪ সালে ৫২, ২০০৫ সালে ৩৪, ২০০৬ সালে ১২০, ২০০৭ সালে সাতজন, ২০০৮ সালে চারজন, ২০০৯ সালে ৪২, ২০১০ সালে ৭৬, ২০১১ সালে ৫৮, ২০১২ সালে ৮৪ এবং ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩০৪ জন নিহত হয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী (ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ ও সংবাদ) ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ২৮৫ জন মানুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে ১৮ জন, ১৯৯২ সালে ৪৫, ১৯৯৩ সালে ২০, ১৯৯৪ সালে ২৪, ১৯৯৫ সালে ২৯, ১৯৯৬ সালে ৪৯, ১৯৯৭ সালে ৬৯ এবং ১৯৯৮ সালে ৩১ জন প্রাণ হারান।
শাসনামল ধরলে ১৯৯১ সালের জুন থেকে ১৯৯৬ সালের মে পর্যন্ত ১৭৪ জন, ১৯৯৬ সালের জুন থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯৮ জন, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৮৭২ জন এবং বর্তমান সরকারের আমলে ৫৬৪ জন মারা গেছেন।

তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, গত ২২ বছরের মধ্যে প্রতিটি সরকারের শেষ বছরে, অর্থাৎ নির্বাচনী বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে ১৮ জন, ১৯৯৬ সালে ৪৯, ২০০১ সালে ৫০০, ২০০৬ সালে ১২০ (নির্বাচন হয়নি) এবং ২০১৩ সালের গত ১০ মাসে ৩০৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। ওই দুই বছরে ১১ জন মারা গেছেন।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। অধিকার বলছে, শুধু ২০০১ সাল থেকে ২০১৩-এর আগস্ট পর্যন্ত সময়েই রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন হাজার ৯২৬ জন এবং আহত হয়েছেন এক লাখ ৫৮ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে ২০০১ সালেই মারা গেছেন ৬৫৬ জন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির ধরনটাই হয়ে গেছে সহিংস। কোনো দলই এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এমনকি কেউ চেষ্টাও করছে না। যখন ক্ষমতার পালাবদলের সময় আসে, তখন এই সহিংসতা আরও বাড়ে। কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে হিংস্রতা বা সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত, জনগণেরও উচিত চাপ সৃষ্টি করা।’

আওয়ামী লীগের শাসনামল: ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৬৪ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের দলীয় কোন্দলেই মারা গেছেন ১৩০ জন।

নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চলতি বছরের ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতালেই ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর আগে এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের সহিংসতায় ২৮৯ জন মানুষ প্রাণ হারান।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৫ জন মারা গেছেন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে। আর ১৮ জন মারা গেছেন জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষে। হরতালের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৩৮ জন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে ১৩ জন এবং আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে ১৫ এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছয়জন মারা গেছেন।

এর আগে ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সে সময় থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ২০০১ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওই দুই মাসে ১৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে।

বিএনপির শাসনামল: ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। সে সময় থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮৭২ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে সন্ত্রাসী হামলায় আওয়ামী লীগের ২০০ নেতা-কর্মী মারা যান। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় মারা যান ২৪ জন।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে ৭৫ জন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৭৫ জন, বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষে ১০ জন ও আওয়ামী লীগের কোন্দলে ১৪ জন মারা যান। বাকিরা হরতাল ও অবরোধসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মারা গেছেন। সেবার ক্ষমতার শেষ সময়ে ২০০৬ সালে ১২০ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারান ৩৬ জন। হরতাল ও অবরোধে প্রাণ হারান ৩৫ জন।

এ ছাড়া ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মে পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সংঘর্ষে ১৭৪ জন প্রাণ হারান।

আন্দোলন হলেও সহিংসতা কম: বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সংবাদপত্রে হরতালচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮-এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সে সময় হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের মতো আন্দোলন হলেও রাজনৈতিক সহিংসতায় খুনোখুনি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৫ সালের ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৯৬ ঘণ্টার হরতালে দুজনের প্রাণহানি ঘটে। এরপর একাধিকবার হরতাল দিলে সে সময় মারা যান আরও ছয়জন। ১৯৯৬ সালের ৯ মার্চ থেকে টানা ১৭ দিন অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে দেশে। সে সময়ও খুব বেশি মানুষ মারা যাননি।

সহিংসতা বন্ধ চায় স্বজনহারাদের পরিবার: সর্বশেষ বিএনপির টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিনে ফরিদপুরের নগরকান্দায় রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা যান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মারুফ শেখ। তাঁর চাচা বাকি শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষমতার রাজনীতিতে সে প্রাণ হারিয়েছে। এভাবে যেন আর কাউকে প্রাণ দিতে না হয়।’

গত ২ মার্চ রাতে জামায়াত-শিবিরের হাতে খুন হন সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক জগৎজ্যোতি তালুকদার। তাঁর বড় ভাই সচিত্র তালুকদার বলেন, ‘এই যে আমার ভাই রাজনীতির কারণে প্রাণ দিল, কোনো দিন কি আমরা তাকে ফেরত পাব? সহিংসতার এই রাজনীতি বন্ধ হোক।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ মারা যান। ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতির কারণে তাঁদের প্রাণ দিতে হয়। এর দায়দায়িত্ব অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর।