হাজারো হজযাত্রীর সেবায় কর্মব্যস্ত হজ ক্যাম্প

আশকোনার হজ ক্যাম্প এখন কোলাহলমুখর। ধবধবে সাদা ইহরামের কাপড়ে আচ্ছাদিত তরুণ-যুবক-প্রৌঢ়-অশীতিপর—নানা বয়সী হাজারো মানুষের ভীষণ কর্মব্যস্ততা সেখানে। তাঁরা সবাই সৌদি আরবে যাবেন, পবিত্র হজ ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে।
গতকাল সোমবার হজ ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, হজযাত্রীদের সেবায় স্থাপিত হজ শিবিরের প্রতিটি শাখাই মুখরিত যাত্রীদের পদচারণে। কেবল ছিলেন না ক্যাম্পে হজ কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সোয়া দুইটা পর্যন্ত এই প্রতিবেদক সেখানে অবস্থান করেন। এ সময় হজ ক্যাম্পের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান ও হজ অফিসের প্রধান সহকারী মো. আবদুর রহিমের কক্ষ তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। আর সহকারী হজ অফিসার মো. আবদুল মালেকের কক্ষ খোলা থাকলেও তাঁকে চেয়ারে দেখা যায়নি। এ তিন কর্মকর্তার খোঁজও দিতে পারেননি আশপাশের কেউ।
এ বিষয়ে জানতে মো. মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে বিকেল পৌনে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
হজ ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার হজযাত্রী সৌদি আরবে যাচ্ছেন। গতকাল ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, হজযাত্রীদের অনেকে ব্যস্ত আছেন ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে। কেউ ব্যস্ত শেষ মুহূর্তে হজের দরকারি মালপত্র কেনাকাটায়। আবার অনেক হজযাত্রী প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস করাতে সারি বেঁধে আছেন। কেউ কেউ ১৫ রিয়ালের টকটাইমসহ বিনা মূল্যে দেওয়া সৌদি মুঠোফোনের সিমটি সংগ্রহ করতে ভুল করছেন না। আবার পাসপোর্ট, টিকিট হাতে না পেয়ে অনেকে রয়েছেন অধীর অপেক্ষায়।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার হজযাত্রী তায়েবুর রহমান জানান, ১ সেপ্টেম্বর তাঁর হজ ফ্লাইট ছিল, কিন্তু যেতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে খালা শাহিদা বেগমও গত বৃহস্পতিবার থেকে হজ ক্যাম্পে বিমানের ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছেন।
তায়েবুর জানান, খালার মাহরেম হয়ে হজে যেতে পুরানা পল্টনের আল আমিন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি হজ এজেন্সিকে টাকা দেন তিনি। এজেন্সি ভিসার জন্য দুজনের পাসপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু ভিসা হয় কেবল তায়েবুর রহমানের। ১ সেপ্টেম্বর তাঁর ফ্লাইটের তারিখও দেওয়া হয়। কিন্তু খালাকে রেখে তিনি যাননি। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার খালা শাহিদা বেগমের ভিসা হয়। এখন তাঁরা বিমানের ফ্লাইট না পেয়ে দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছেন বাংলাদেশ বিমানের হজ ক্যাম্প কার্যালয়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমানের হজ ক্যাম্প শাখার ডিউটি ম্যানেজার (হজ) এ টি এম জি মোস্তফা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘তায়েবুর রহমান ও শাহিদা বেগমকে আমরা অপেক্ষমাণ তালিকায় রেখেছি। আসন খালি পাওয়া গেলেই আমরা তাঁদের পাঠিয়ে দেব।’
বাংলাদেশ বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইনস সূত্র জানায়, গত সোমবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৩৩ হাজার ৬৩৮ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান পরিবহন করেছে ২২ হাজার ২৪ জন যাত্রী। আর সৌদিয়া এয়ারলাইনস করেছে ১১ হাজার ৬১৩ জন। গত ২৮ আগস্ট থেকে হজযাত্রী পরিবহন শুরু করে বিমান।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এবার বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ তিন হাজার ১৪ জন যাত্রী হজে যাবেন। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ৫১০ জন যাবেন সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এসব যাত্রীর অর্ধেক বাংলাদেশ বিমান ও অর্ধেক সৌদিয়া এয়ারলাইনস পরিবহন করবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৮ আগস্ট হজ ফ্লাইট শুরুর পর গত ১২ দিনে হজযাত্রীদের নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। হজ ক্যাম্পেও কোনো ধরনের হট্টগোলের খবর পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোভার স্কাউটের ২০ সদস্যের একটি দলও নিয়মিত হজযাত্রীদের সহায়তা করছে।
হজযাত্রীদের জন্য সেবা: অন্যবারের মতো এবারও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হজযাত্রীদের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য, খাদ্য, পানীয়সহ নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে। ১৫টি সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সেখানে অস্থায়ী কার্যালয় খুলে হজযাত্রীদের নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে সৌদি আরবের একটি মুঠোফোন কোম্পানির সিম হজযাত্রীদের বিনা মূল্যে দিচ্ছে ইন্ট্রাকো নামের একটি প্রতিষ্ঠান। হজ ক্যাম্পের দ্বিতীয় তলা থেকে গতকাল অনেক হজযাত্রীকে সিমটি সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
কুমিল্লার বুড়িচং এলাকার হজযাত্রী আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, আত্মীয়স্বজন মোবাইল নম্বরের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। সিমটি এখানে পেয়ে যাওয়ায় নম্বরটি আগেভাগে দেওয়া যাচ্ছে।
এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াক্ফ) হজ ক্যাম্প উদ্বোধনের দিন থেকে সেখানে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র খুলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের ভ্যাকসিন দিচ্ছে। এর পাশাপাশি কোনো হজযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে সে অনুযায়ী চিকিৎসকেরা ওষুধ ও পরামর্শপত্র দিচ্ছেন। একইভাবে হামদর্দের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের জ্বর, ঠান্ডা, মাথা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, আমাশয়সহ সাধারণ অসুখের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হামদর্দ ফাউন্ডেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক মোস্তফা মাহমুদ বলেন, ‘হজে গিয়ে আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এমন সাতটি সাধারণ রোগের জন্য একটি প্যাকেজ করে আমরা হজযাত্রীদের ওষুধ দিচ্ছি।’
প্রথম আলো এবারও হজযাত্রীদের বিনা মূল্যে হজ গাইড দিচ্ছে। এই নিয়ে টানা আট বছর হজ গাইড দেওয়া হলো। প্রতিবারই এক লাখ করে হজ গাইড দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে হজযাত্রীদের জন্য বিনা মূল্যে পাউরুটি ও বোতলজাত পানি সরবরাহ করতে দেখা যায়।