হাতবদলের চক্রে মোহিনী মিল

কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিলটি আবার হাতবদল হচ্ছে। ৯৯ বিঘা জমিসহ মিলটি ইনারগোটেক লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। এ নিয়ে মোট পাঁচবার মিলটি হস্তান্তর করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।সর্বশেষ হস্তান্তরে জমিসহ মিলটির দাম ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তবে মন্ত্রণালয় এই মূল্য নির্ধারণ করেছে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের পর্যালোচনা অনুযায়ী। এর মধ্যে তিন বছর পার হয়েছে। এই সময়ে হস্তান্তরের জন্য আরও তিন দফা চুক্তি হয়েছিল তিনটি পক্ষের সঙ্গে। কিন্তু তারা সময়মতো টাকা না দেওয়ায় ইনারগোটেক লিমিটেডের মালিক আরিফুর রহমানের সঙ্গে সর্বশেষ চুক্তি হয়।
যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও লিকুইডেটর সাইফুদ্দিন আহম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক ক্রেতা শাহ্ মখদুম মিলস লিমিটেড মোহিনী মিলের সমস্ত সম্পত্তি ইনারগোটেকের কাছে হস্তান্তর করেছে। এখানে মন্ত্রণালয় কেবল মধ্যস্থতা করেছে।
তবে মন্ত্রণালয়েরই একাধিক সূত্র বলছে, মিলটি হস্তান্তরে শাহ্ মখদুম কর্তৃপক্ষের আইনগত অধিকার নিয়েই প্রশ্ন আছে। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৪ সালে ১১ কোটি টাকায় নিলামে মিলটি কিনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা পুরো টাকা পরিশোধ না করায় একবার তাদের পরিশোধ করা টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
হাতবদলের দীর্ঘ ইতিহাস: ১৯১২ সালে মোহিনী মোহন চক্রবর্তী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগৎ কিশোর চৌধুরী ও চমন লাল কুষ্টিয়ায় মোহিনী মিল স্থাপন করেন। ’৭২ সালে মিলটিকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। কিন্তু টানা লোকসানের কারণে ১৯৮২ সালে সরকার এটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই বছর পর তৃতীয়বারের দরপত্রে নজরুল ইসলাম নামের এক শিল্পপতি ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় মিলটি কিনে নেন। ওই সময় তিনি এক কোটি ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়। তখন মিলের নাম বদলে রাখা হয় ‘শাহ্ মখদুম টেক্সটাইল মিল’।
১৯৮৫ সালের ৩১ জানুয়ারি মিলটি ফের চালু হয়। নজরুল ইসলাম শাহ্ মখদুম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ সালে কোম্পানিটি অগ্রণী ব্যাংক থেকে পৌনে তিন কোটি টাকা ঋণ নেয়। কিন্তু পুরো পাওনা পরিশোধ না করায় সরকার ১৯৯০ সালে মিলটি ফেরত নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে তখন পর্যন্ত নজরুল ইসলামের জমা দেওয়া মোট দুই কোটি ৩১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি মিলটি বিক্রির জন্য আবারও দরপত্র ডাকা হয়। তখন অগ্রণী ব্যাংক ও নজরুল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বিক্রি কার্যক্রম স্থগিত হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে শাহ্ মখদুম তৃতীয় আরেকটি পক্ষ দ্য পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস করপোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেডের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলটি চালুর চুক্তি করে।
চুক্তিতে বলা হয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সরকার মোহিনী মিল বাবদ ক্রেতার (নজরুল) কাছ থেকে বিক্রীত মূল্য, সরকারের হাতে থাকার সময়ে নেওয়া ঋণ ও অনুদানের সুদ-আসলে (১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত) মিলে ৪৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পাবে। এর মধ্যে ৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাস এবং বাকি ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর করা ওই চুক্তিতে বলা হয়, আগের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে না।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে মন্ত্রণালয় আবদুল মতিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আবার একই দামে বিক্রির চুক্তি করে। কিন্তু তখনো সঙ্গে ছিল পিডিএসসি। চুক্তি অনুযায়ী, সরকারকে এক কোটি ১০ লাখ এবং অগ্রণী ব্যাংককে ১১ কোটি টাকা পরিশোধ করে ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা মিলটি চালায়।
কিন্তু এবারও পুরো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০১২ সালের ১৭ জুলাই মেসার্স দিনার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম আসলামের কাছে মোহিনী মিল হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়। তাঁকে ২৮ দিনের মধ্যে সব টাকা পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়। তিনি মাত্র ছয় কোটি টাকা দিতে সক্ষম হন। পরে মন্ত্রণালয় ওই চুক্তি বাতিল করে ইনারগোটেকের সঙ্গে গত মার্চ মাসে সর্বশেষ চুক্তি করে।
এবারের চুক্তিতে যা আছে: ইনারগোটেক সরকারকে তিন মাসে ৪৮ কোটি টাকা পরিশোধ করবে। আর এই জমি বন্দক রেখে শাহ্ মখদুমের মালিক নজরুল ইসলামের নেওয়া ঋণের সুদাসলসহ ব্যাংকের পাওনা বাবদ ১০ থেকে ১২ কোটি টাকাও পরিশোধ করতে হবে বর্তমান মালিককে। আর শাহ্ মখদুম ও দিনার কর্তৃপক্ষকেও ২০ দিনের মধ্যে ছয় কোটি টাকা করে দিতে হবে নতুন ক্রেতাকে। তা ছাড়া আবদুল মতিন, পিডিএসসি ও এম আসলামের যে টাকা সরকারকে দিয়েছিলেন, তা-ও পরিশোধ করতে হবে ইনারগোটেককে।
ইনারগোটেক ইতিমধ্যে সরকারকে ১০ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা প্রতি তিন মাস অন্তর সমান চার কিস্তিতে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। তবে পর পর দুটি কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে ইনারগোটেকের সঙ্গে করা চুক্তিটি বাতিল বলে গণ্য হবে। আর মিলটি বিক্রি করতে হলে ইনারগোটেককে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
১০ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর মন্ত্রণালয় গত ২৬ আগস্ট কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে মিলটি ইনারগোটেক কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে চিঠি দেয়। ইনারগোটেককে মিলের পুরোনো যন্ত্রাংশ বিক্রি করার অনুমতিও দেয় মন্ত্রণালয়।
যোগাযোগ করা হলে বর্তমান ক্রেতা আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্ত দায়-দেনা ও আইনগত বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মিলটি কিনেছি।’ মিলের জায়গায় কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএমআরই ইউনিটটি চালু করব। তারপর অন্য কোনো কারখানা স্থাপন করব।’
তবে একবার বাজেয়াপ্ত এবং আবার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার পরও মিল হস্তান্তর করার আইনগত অধিকার আছে কি না, জানতে চাইলে শাহ্ মখদুম মিলস লিমিটেডের বর্তমান চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের বোঝা থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই মিলটি হস্তান্তর করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই পুরো বিষয়টি করা হয়েছে।’
সরেজমিন: মিলের ৯৯ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে কারখানা আছে প্রায় ২৮ বিঘা জমির ওপর। কারখানার ভেতরের যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত। বিএমআরই ইউনিট এখন বন্ধ।
ওই জমিতে চারটি মসজিদ, চারটি মন্দির, একটি স্কুল, একটি কলেজ, খেলার মাঠ, একটি দাতব্য হাসপাতাল রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, পুরো জায়গা কুষ্টিয়া পৌরসভার ভেতরে হওয়ায় এখানকার জমির কাঠাপ্রতি দাম বর্তমানে ১০ লাখ টাকার ওপরে। সেই হিসাবে ৯৯ বিঘা জমির বাজারদর ১৯৮ কোটি টাকা।
জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মেয়র আনোয়ার আলী দাবি করেন, মন্ত্রণালয়ের একটি অংশ অন্যায় ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সঙ্গে আছেন কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের তথাকথিত পাঁচ নেতা। এভাবে মিল বিক্রি হতে পারে না।
জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, অল্প মূল্যে মোহিনী মিল বিক্রির প্রচারণা ডাহা মিথ্যা। প্রকৃত বিষয় হলো, বহু দেনদরবারের পর বহু বছরের জটিল এ বিষয়টির একটা সুরাহা হতে যাচ্ছে।
এই মিল বিক্রির প্রতিবাদে মোহিনী মিল রক্ষা কমিটি ও মোহিনী মিল সংগ্রাম পরিষদ নামে দুটি সংগঠন হয়েছে। মিলসংলগ্ন এলাকায় তারা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। তাদের দাবি, একটি মহল প্লট আকারে এই জমি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
একই রকম আশঙ্কা করে কুষ্টিয়া পৌরসভায় মেয়র গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর চিঠি দিয়েছেন।
মোহিনী মিল রক্ষা কমিটির সদস্য হাবিবুল হক বলেন, ‘মিল বিক্রিতে যদি মন্ত্রণালয়ের কোনো অনিয়ম হয়, তবে তার নিন্দা জানাই। তবে এখানে কোনো আবাসন করতে দেওয়া হবে না।’
এ বিষয়ে পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ওখানে কারখানা করা না হলে সরকারের সম্পত্তি সরকারের কাছে ফেরত আসবে—ক্রেতার সঙ্গে এমন চুক্তিই করা হয়েছে।