
তখন মিমের আট বছর। তাকে পাঠানো হলো ঢাকায়, একজনের বাসায় কাজ করতে। ২০১৩ সালে যেদিন প্রথম ঢাকায় এল সে, তার পরদিনই ডিম আনতে তাকে পাঠানো হলো বাসার পাশের দোকানে। ডিম কেনার পর বাসাটি আর খুঁজে পেল না ছোট্ট মিম। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনে, কীভাবে যেন উঠে পড়ল একটি ট্রেনে। সেই ট্রেন তাকে নিয়ে গেল চট্টগ্রামে। অচেনা শহরে মিমের ঠাঁই হয় একটি শিশুনিবাসে। নাম যার ‘উপলব্ধি’।
মিমের মতো হারিয়ে যাওয়া বহু শিশু নিজের বাড়ির ঠিকানা জানে না। মা-বাবার পুরো নামও তাদের অনেকে ভালো করে বলতে পারে না। মা-বাবা কী করেন, তা-ও অজানা অনেকের। ঘটনাচক্রে পরিবার ও স্বজনের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া এমন ৫০ শিশুর ঠিকানা এখন ‘উপলব্ধি’। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের এই প্রতিষ্ঠানটিতে হারিয়ে যাওয়া মেয়েশিশুদের আশ্রয় জোটে।
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ‘উপলব্ধি’ হারিয়ে যাওয়া, পথে পাওয়া অসহায় ওই শিশুদের লালনপালনের দায়িত্ব নিয়েছে। এখানে ওরা থাকে, লেখাপড়া করে, স্কুলে যায়। তাদের জন্য রয়েছে গৃহশিক্ষক, শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে নিয়মিত চিকিৎসক আসেন। পড়ালেখা ছাড়াও ছবি আঁকা, আবৃত্তি, নাচসহ নানা রকম সৃজনশীল কাজের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে এসব শিশু।
ফিরিঙ্গি বাজারের ৭১ নম্বর শিববাড়ি সড়কের ছয়তলা একটি আবাসিক ভবনের দুটি তলায় ৫০ শিশুর অন্য রকম একটি আশ্রয়স্থল গড়ে উঠেছে। একদিন অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সেখানে বেড়ে উঠছে তারা। এসব শিশু নগরের বিভিন্ন স্কুলে পড়ছে। গত ২৮ আগস্ট বিকেলে ওই ভবনের সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠতেই শিশুদের কোলাহল শোনা গেল। পঞ্চম তলায় পৌঁছেই পাওয়া গেল খুদে বাসিন্দাদের। ঢুকতেই হলরুমের মতো বড় একটি কক্ষ। ১০-১২টি শিশুর একটি দল গৃহশিক্ষককে ঘিরে মেঝেতে বসে আছে। তাদের পড়ানো হচ্ছে। এই দল থেকে কিছুটা দূরে আরেকটি দল ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত। আর কক্ষের এক কোণে নাচের মহড়া দিচ্ছে বেশ কয়েকটি শিশু। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা ঘটনাচক্রে একটি জায়গায় এসে মিলিত হয়েছে এরা। একেকজনের হারিয়ে যাওয়ার গল্পও একেক রকমের।
উপলব্ধির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শেখ এজাবুর রহমান বললেন, ২০১৩ সালে মিম ঘটনাচক্রে চলে এল চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে, আর চারদিকের অপরিচিত পরিবেশ দেখে কাঁদছিল সে। রেলস্টেশনের এক কুলি প্রথম তাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। পরে পুলিশের মাধ্যমে এখানে আসে সে। এখন আর তার ভয় নেই। সে একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কবিতা আবৃত্তি করে, নাচও শেখে।
এ রকম হারিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী শেফালী আক্তারের কাছে তার নামের অর্থ জানতে চাইলে সে বলে, ‘শিউলি ফুল, রাতে ফোটে, দিনে ঝরে যায়।’
শেফালি থাকত সৎমায়ের সংসারে। মা তাকে সিলেটের একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজে পাঠান। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই চলত তার ওপর নির্যাতন। সহ্য করতে না পেরে একদিন সে পালিয়ে যায়। এরপর কীভাবে যেন চলে আসে চট্টগ্রামে। ঠাঁই হয় এখানে। এখানে তুমি কেমন আছ? এ প্রশ্নের জবাব শেফালি দিয়েছে চোখের পানিতে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে সে পড়ালেখা করতে চায়।
শেফালি পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও এখন কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। সে পড়ে ফিরিঙ্গিবাজারের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বছর স্কুলের ১০০ মিটার দৌড়, উচ্চ লাফ, মোরগ লড়াই ও দীর্ঘ লাফে প্রথম হয়েছে। তিরধনুক নিক্ষেপ প্রতিযোগিতাতেও ভালো করেছে সে। তবে এখনো ক্রিকেট সেভাবে না খেললেও তার স্বপ্ন বড় ক্রিকেটার হওয়া!
উপলব্ধি-এর কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে তাহমিনা আক্তার (তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে) ও পূজা দাশ (প্রথম শ্রেণি) নিজ নিজ স্কুলে এবার প্রথম হয়েছে। অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী বিলকিস আক্তার ২০১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে। বিলকিসের আবৃত্তি শুনে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। বই পড়া প্রতিযোগিতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এ বছর তাকে পুরস্কৃত করেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির নারগিস আক্তার গত বছর আন্তপ্রাথমিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নৃত্য বিভাগে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেয়।
উপলব্ধির শিশু বিতার্কিক দল (বিলকিস আকতার, আসমা আক্তার এবং ইসরাত জাহান) একটি এনজিও আয়োজিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এ বছর চট্টগ্রাম জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় সেরা হয়েছে।
উপলব্ধির গৃহশিক্ষক শর্মিষ্ঠা চৌধুরী বলেন, ওদের পড়িয়ে অনেক আনন্দ পান তিনি। একসময় ওরা অনেক কিছু করতে পারবে।

ফিরে পাওয়ার গল্পও রয়েছে
ফারজানার বাড়ি হবিগঞ্জে। ঢাকার একটি বাসায় কাজ করত সে। কথায় কথায় গালমন্দ আর অতিরিক্ত কাজের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন পালিয়ে যায় সে। শেষে ঠাঁই হয় উপলব্ধিতে। শিশুটি তার বাড়ির ঠিকানা জানত না। শুধু মা-বাবার নাম বলতে পারত। উপলব্ধিতে এসেও তার মন টেকে না। সব সময় মার কাছে ফিরে যেতে চাইত।
একদিন কবি বাদল সৈয়দ গিয়েছিলেন উপলব্ধিতে। তাঁর কর্মস্থল এখন সিলেটে। তিনি ওখানকার প্রধান কর কমিশনার। মাকে দেখার জন্য ফারজানার আকুলতা তাঁর মন ছুঁয়ে গেল। তিনি ফারজানার ছবি তুললেন। তারপর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শিশুটিকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিলেন। সেই স্ট্যাটাসটি শেয়ার করল অনেকেই। বাদল সৈয়দ বললেন, তিনি উপলব্ধিতে যান গত ২৫ জুন ঈদুল ফিতরের আগের দিন। সেদিনই ফারজানার বিস্তারিত বিবরণ লিখে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন।
পরদিন রাসনা আক্তার নামের এক নারী ফেসবুকে তাঁকে জানান, তিনি ফারজানার মা-বাবাকে চেনেন। পরে ফারজানার ভাই চট্টগ্রামে আসেন। ফারজানার শরীরে একটি জন্মদাগ রয়েছে। এটি তার ভাই বলার পর বাকি সবকিছু ভালোভাবে যাচাই করেন তারা। শিশুটি খুঁজে পায় তার পরিবার।
তবে ফারজানা এখন উপলব্ধিতেই আছে। সে এখানে থেকেই লেখাপড়া করতে চায়। তবে মা-বাবার সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
‘উপলব্ধি’র শুরুর কথা
পদ্মা অয়েল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ এবং প্রশাসন) শেখ এজাবুর রহমানের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। ২০১০ সালের কোনো এক শুক্রবার তিনি বাজার করতে যান চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট এলাকায়। সেদিন একটি ছোট্ট ছেলে তাঁর বাজারের ব্যাগ ধরে টানছিল। ছেলেটি কোথায় থাকে তিনি জানতে চান। জবাবে বলেছিল সে ‘নাইট শেল্টারে’ (ছিন্নমূল শিশুদের রাতে থাকার ব্যবস্থা) থাকে। নাইট শেল্টারের কথা শুনে তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। ছেলেটির কাছে নাইট শেল্টারের ঠিকানা জানতে চান এবং তার সঙ্গে তিনি সেখানে যান। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায় দেশীয় একটি এনজিও এক প্রকল্পের অধীনে সুবিধাবঞ্চিত ছেলেশিশুদের রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সেখানে। এরপর থেকে নিয়মিত সেখানে যেতেন। সাধ্যমতো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। একটা সময় ওই প্রকল্পে বিদেশি আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এনজিওটি নাইট শেল্টার প্রকল্প আর চালাতে পারেনি। তখনই এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা মাথায় আসে শেখ এজাবুরের।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেখ এজাবুর, তাঁর স্ত্রী শাহনাজ বেগম ও কন্যা তাহসিন রহমানকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি করে ‘উপলব্ধি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। ব্যাংক হিসাব খোলা হয় এই প্রতিষ্ঠানের নামে।
নাইট শেল্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওই বেসরকারি সংস্থাটি পরিচালিত মেয়েশিশু আশ্রয়কেন্দ্রকে উপলব্ধির পক্ষ থেকে প্রথমে সহায়তা দেওয়া হয়। কিছুদিন পর বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে মেয়েশিশু আশ্রয়কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন আশ্রয়কেন্দ্রটির দায়িত্ব নেয় উপলব্ধি। সেটা ২০১৫ সালের ঘটনা। সে সময় আশ্রিত মেয়ের সংখ্যা ছিল ২৫ জন। তাদের নিয়েই উপলব্ধির যাত্রা শুরু। পরিচিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধুবান্ধবকে সম্পৃক্ত করে ফিরিঙ্গিবাজারে একটি ভবনের দুটি তলা ভাড়া নিয়ে ওই শিশুদের এখানে নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি আকারে বড় হতে থাকে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির হয়। ঠিক হয় একটি স্লোগান ‘শিশুর ঠিকানা ফুটপাত-রাস্তা আর না।’
হারিয়ে যাওয়া কিংবা মা-বাবাহারা শিশুদের রাখার জন্য আইনগত ভিত্তিটাও তৈরি করতে হয়েছে উপলব্ধিকে। নিতে হয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন। এখানে বেশির ভাগ শিশু আসে পুলিশের মাধ্যমে। প্রতিদিন প্রতিটি শিশু সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে হয়।
অর্থের উৎস
উপলব্ধির ব্যবস্থাপক শেলী রক্ষিত জানান, ৫০ জন শিশুর লালনপালন, ওদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পড়াশোনা, দুজন গৃহশিক্ষক, দুজন হাউস মাদারসহ (তত্ত্বাবধায়ক) যাবতীয় খরচ মাসে ২ লাখ টাকা। তিনি বলেন, উপলব্ধি কোনো প্রকল্পনির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় এটি চলছে না। স্থানীয় লোকজনের আর্থিক সহযোগিতা এবং ২৩ জন সদস্যের মাসিক চাঁদায় চলে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় প্রাপ্তি সদস্য ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে আমরা প্রায় ৩০-৩৫ জন ডোনার (পৃষ্ঠপোষক) সংগ্রহ করতে পেরিছি। তাঁরা প্রতি মাসে এক-একটা শিশুর পরিচর্যার আর্থিক খরচ আমাদের কাছে পৌঁছে দেন।’ তিনি বলেন, এমন অনেক ডোনার আছেন যাঁরা নিজেদের নামও প্রকাশ করতে চান না।
উপলব্ধির দুটি ফ্লোর ঘুরে দেখা গেল শিশুদের পড়ার উপযোগী বই দিয়ে একটি ছোট পাঠাগার রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। দুজন চিকিৎসক নিয়মিতভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর উপলব্ধি পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরা কোথায় যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিষ্ঠাতা এজাবুর রহমান বলেন, ভবিষ্যতে তাঁরা দক্ষতা উন্নয়ন বিভাগ খুলতে চান। যেসব শিশুর বয়স ১৬ পেরিয়ে যাবে, তাদের মধ্যে যারা লেখাপড়ায় ভালো তাদের সেখানে রাখা হবে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে লক্ষ করেছি এই শিশুরা তাদের বাবা-মার অভাব অনুভব করে, তাদের সাহচর্য পেতে চায়। আবার আমাদের সমাজে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আছে, যাদের দেখভাল করার কেউ নেই। তারাও সন্তান-সন্ততির অভাব অনুভব করে, তাদের সাহচর্য পেতে চায়। আমরা এই দুইয়ের অভাব ও ইচ্ছাকে একটি বিন্দুতে এনে মিলিয়ে দিতে চাই। তাই আমরা একটা বয়স্ক নিবাস প্রতিষ্ঠারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’