হার না-মানা হালিমা

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন খড়ির সন্ধানে। গ্রামের মাঠে মাঠে ঘুরে খড়ি সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরেন। এরপর সংসারের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে খড়ি ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামের সড়কের পাশে বসে চুলায় খড়ি দিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালান। জিলাপি ও পেঁয়াজুর উপকরণ বাড়ি থেকেই তৈরি করে আনেন। চুলায় বসানো কড়াইয়ের তেল গরম হয়ে এলে বানানো শুরু করেন জিলাপি আর পেঁয়াজু। চলে রাত দশটা পর্যন্ত।

আট বছর ধরে এভাবেই সংগ্রাম করে সংসারের চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন জয়ী নারী হালিমা খাতুন (৫২)। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাধাগোবিন্দপুর গ্রামে হালিমার বাস। সংসারে শুধু স্বামী আমির উদ্দীন রয়েছেন। তবে অসুস্থ থাকায় তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না। আর একমাত্র ছেলে বিয়ে করে ১৫ বছর আগেই আলাদা হয়ে গেছেন।

গত বুধবার বিকেলে রাধাগোবিন্দপুর গ্রামে দক্ষিণপাড়ায় যেতে চোখে পড়ে হালিমার জিলাপি ও পেঁয়াজু বানানোর দৃশ্য। গাংনী উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। গ্রাম ঘেঁষেই ভারতীয় সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া। সন্ধ্যায় ভারতের সীমানার আলো জ্বলজ্বল করে। হালিমার সংসারও জ্বলজ্বল করে তাঁর সংগ্রামের কারণে।
কাথুলী-তেঁতুলবাড়িয়া সড়কের পাশে রাধাগোবিন্দপুর গ্রামের হালিমার ছোট্ট একটা টংঘর। এর পাশেই জিলাপি তৈরির মাটির চুলা।

সংসারের হাল কেন হালিমার হাতে, জানতে চাইলে জিলাপি তৈরির ফাঁকে ফাঁকে শোনালেন সেই গল্প।
স্বামী আমির উদ্দীন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। ১৫ বছর আগে একমাত্র ছেলে আসাদুলের বিয়ে দেন। বিয়ের পর স্ত্রী নিয়ে ছেলে আলাদা হয়ে যান। আসাদুল গ্রামে ঘুরে ফুচকা বিক্রি করেন। আট বছর আগে হালিমার স্বামী হঠাৎ করে স্ট্রোক করেন। এখনো অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই উপার্জনও নেই। শুরুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন হালিমা। কী করে সংসার চালাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ভিক্ষাবৃত্তি করার ইচ্ছে কোনো দিন হয়নি। তখন ছেলের শাশুড়ির কাছ থেকে জিলাপি তৈরি করা শেখেন। গ্রামের বাজারে জিলাপি তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। আস্তে আস্তে তাঁর বানানো সুস্বাদু জিলাপি ও পেঁয়াজুর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। সংসারের চাকা ঘুরতে থাকে।

এ বছরের এপ্রিল মাসের দিকে বাজারের দোকানটি বেহাত হয়ে যায়। তখন এলাকার ব্যবসায়ী ফিরোজ হোসেনের বাড়ির সামনে সড়কের পাশে একটু খোলা জায়গায় টংঘর করেন। হালিমার পাশেই বসে ছিলেন আমির উদ্দীন। দাঁড়িপাল্লায় ওজন দিয়ে জিলাপি বিক্রিতে তিনি সহযোগিতা করছিলেন।

মেহেরপুরের সংগ্রামী নারী হালিমা খাতুন। জিলাপি ও পেঁয়াজু তৈরি ও বিক্রি করে সংসার চালান। ছবি: তৌহিদী হাসান
মেহেরপুরের সংগ্রামী নারী হালিমা খাতুন। জিলাপি ও পেঁয়াজু তৈরি ও বিক্রি করে সংসার চালান। ছবি: তৌহিদী হাসান

হালিমা বলেন, নারী হয়ে রাস্তায় বসে জিলাপি ও পেঁয়াজু তৈরি করেন বলে অনেকে নানা কথা শোনাতেন। কিন্তু তিনি কর্ণপাত করেননি। কারও কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতে হচ্ছে না—এতেই তিনি খুশি।
গ্রামের ছোট-বড় মানুষ ছাড়াও পথচারী অনেকেই হালিমার জিলাপি ও পেঁয়াজু কিনে খান। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বিক্রি হয়। তাতেই স্বামী-স্ত্রীর সংসার চলে যায়।
গ্রামের মধ্যপাড়ায় এক টুকরা জমিতে টিনের ঘর করে বসবাস করেন হালিমা। এ ছাড়া আর জমিজমা নেই।
ওই গ্রামের যুবক ফিরোজ হোসেন জানান, হালিমার জিলাপি ও পেঁয়াজু এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। খাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও তা নিয়ে যান।
নিজের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে দৃঢ়কণ্ঠে হালিমা বলেন, ‘এ কাজ করেই আমি খাচ্ছি, আমার কোনো আশা নাই, বিষয়ও নাই। এতেই আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা হলেও এটা, কোটিপতি হলেও এটা, ফকির হলেও এটা। আর কিছু নাই।’