হাসিমুখে রোগীর পাশে

করোনা রোগীদের মুখে হাসি ফোটানোর সব চেষ্টাই করেন সাইফুল ইসলাম
ছবি: খালেদ সরকার

গোলাপ হাতে হাপুস নয়নে কাঁদছেন এক নারী। পাশে এক পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে হাসছেন, যাঁর পরনে পুলিশের পোশাক। আপাতদৃষ্টে এ দৃশ্য বেমানান হলেও এই কান্নায় কোনো বেদনা নেই, আছে আনন্দ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যমের মুখ থেকে বেঁচে ফিরে আসার আনন্দ। এ কান্না সেই সুখের প্রকাশ।

ঢাকার রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের প্রধান ফটকে এমন কান্নার দৃশ্য প্রতিদিনের। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় তাঁদের হাতে একটি করে গোলাপ ধরিয়ে দেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। গোলাপ হাতে নিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার খুশিতে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরেন রোগীরা।

যে কর্মকর্তা এভাবে রোগীদের হাতে গোলাপ তুলে দেন, তাঁর নাম সাইফুল ইসলাম, সানতু নামেই পরিচিত। ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেওয়া সাইফুলের কর্মজীবনের ১২ বছর পেরিয়ে ১৩ বছরে পড়েছে। তিনি এর আগে মুন্সিগঞ্জ জেলা, র​্যাব ও এপিবিএন পুলিশে চাকরি করেছেন।

কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা রোগী মুক্তার হোসেন বলেন, সাইফুল ইসলাম তাঁর দলবল নিয়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের দেখভাল করেন। প্রত্যেক রোগীর কাছে গিয়ে হাসিমুখে জানতে চান, ‘কেমন আছেন?’ হাসলে তাঁর চোখও হাসে। এন–৯৫ মাস্ক সে হাসি আড়াল করতে পারে না। সাইফুলের হাসিতে মনমরা মানুষেরা যেন প্রাণ ফিরে পান।

কামরুল হাসান

ঝাঁ–চকচকে বলতে যা বোঝায়, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল তেমনই। পুলিশ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্ধারিত এই হাসপাতালকে এ পর্যন্ত টেনে আনার ক্ষেত্রে যাঁর কৃতিত্ব, তিনি হলেন হাসপাতালটির পরিচালক উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাসানুল হায়দার। নিবেদিতপ্রাণ কিছু কর্মকর্তাকে তিনি এক ছাতার নিচে জড়ো করেছেন। তাঁদেরই একজন সাইফুল ইসলাম।

বরগুনার ছেলে সাইফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এমএ পাস করে কিছুদিন আইনজীবী হয়ে ব্যারিস্টারি পড়তে শুরু করেছিলেন লন্ডনে। ২০০৮ সালে বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সব ছেড়ে দিয়ে পুলিশে যোগ দেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা, স্ত্রী সোনিয়া তামান্না আইনজীবী। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে যোগ দেওয়া সাইফুল ইসলাম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

করোনার চিকিৎসা নিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ হাসপাতালে যখন কোভিডের চিকিৎসা শুরু হয়, তখন মানুষের মনে ভীতি চরমে ছিল। পুলিশ হাসপাতালের প্রথম রোগীকে কুর্মিটোলা পাঠানোর সময় গাড়িচালক স্ত্রী–সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, যদি আর ফিরে না আসেন। তবে সেই ভীতি এখন আর নেই। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল এখন পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে। পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা পুলিশ হাসপাতালে আছে।

প্রথম দিকে সাইফুল ইসলাম লক্ষ করেন, কেউ কোভিডে আক্রান্ত হলেই তিনি ধরে নিতেন আর বাঁচবেন না। চিকিৎসক ও নার্সরাও ভয়ে রোগীর কাছে ঘেঁষতেন না। তাঁরা দূর থেকে ওষুধপথ্য দিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতেন। সাইফুল ভাবলেন, এভাবে চলতে থাকলে আতঙ্কিত মানুষটি এমনিতেই মরে যাবেন। মানুষ হয়ে চোখের সামনে অন্য মানুষের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাই আক্রান্ত রোগীদের মনে সাহস দিতে ১০–১২ জনের একটি দল গঠন করেন। এ দলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি থেকে শুরু করে জরুরি প্রয়োজনের সবাইকে রাখা হয়। প্রথম দিকে তিনি একা পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) পরে রোগীদের কাছে যেতে শুরু করেন। রোগীরা বাইরের লোক বলতে শুধু তাঁকেই দেখতেন। এরপর চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে করে রোগীর কাছে যাওয়া শুরু করেন। এতে রোগীদের মনে জোর ফিরে আসে। সাইফুল বলেন, ‘আমাদের দলটি রোগীদের মানসিকভাবে শক্ত রাখার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে করোনার ভীতি কেটে যায়।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম তাঁর স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে থাকেন উত্তরার বাসায়। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হন। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ১০টা। করোনা শুরু হওয়ার পর সাত মাসে এক দিনও সাপ্তাহিক ছুটি কাটাননি তিনি।

এখন ওয়ার্ডে গেলে অনেক রোগী তাঁকে জড়িয়ে ধরেন, কেউ কেউ হাত ধরে বসে থাকেন। বয়স্করা কিছু শুনতে চান না। তাঁদের বুঝিয়ে সামাল দিতে হয়। একজন রোগী মারা যাওয়ার আগে নার্সের কাছ থেকে কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়েছিলেন। তাতে লেখেন, ‘সানতু ভাই ভালো।’ এটুকু লিখেই রোগী মারা যান, আর লিখতে পারেননি। ওই রোগীর এই লেখাটি তিনি সব সময় সঙ্গে রাখেন। তিনি বলেন, এই লেখার মূল্য হাজার কোটি টাকা। জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়ার নেই। এটুকু বলতে বলতেই চুপ হয়ে যান, তাঁর চোখ ভিজে আসে।


কামরুল হাসানপ্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি