
গ্রামটির বাঁশি তৈরির ঐতিহ্য এক শ থেকে সোয়া শ বছরের। পরম্পরা ধরে রেখে পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিশীল কাজটি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ। শুধু টিকে থাকাই নয়, কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দী গ্রামের কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশি যাচ্ছে দেশের বাইরেও।
শুরুর সুলুক সন্ধান: শ্রীমদ্দী গ্রামের অন্তত ৪০টি পরিবার নানা নাম, আকার আর গড়নের বাঁশি তৈরির কাজ করে। এখানে বাঁশি তৈরি শুরুর গল্পটা জানতে কথা হয় গ্রামটির বেশ কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, এক শ থেকে সোয়া শ বছর আগে গ্রামের কোকিল দাস বৈরাগী ও দীনবন্ধু প্রথম বাঁশি তৈরি করেন। বর্তমানে ভারতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ছিল তাঁদের। সেখান থেকে দেখে এসে বাঁশি তৈরি শুরু করেন তাঁরা। প্রথমদিকে অল্প কিছুসংখ্যক বাঁশি তৈরি করে নিজেরাই ফেরি করে বিক্রি করতেন। দুজনই চমৎকার বাঁশি বাজাতেও পারতেন। তাঁদের কাছ থেকে অন্যরা এ কাজ শেখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে কোকিল দাস ও দীনবন্ধু সপরিবারে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যান।
বাঁশি তৈরি ও বিক্রির কাজ করেছেন শ্রীমদ্দীর বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী রুই দাস। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে বাঁশির বাজার অনেক ভালো ছিল। চৈত্র মাস এলে ঢাকার চকবাজারে এক থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত বাঁশি বিক্রি হতো। তিনি বাঁশি তৈরি করা ছাড়াও পাইকারি কিনে বিভিন্ন মোকামে বিক্রি করতেন। খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেই সময় চিঠি লিখে বাঁশির অর্ডার দিতেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে একদিন: সম্প্রতি একদিন শ্রীমদ্দীতে গিয়ে দেখা গেল, বাঁশি তৈরির কাজ করছেন অনেকেই। কেউ ছোট ছোট করে মুলি (বাঁশ) কাটছেন। কেউ সিক দিয়ে ছিদ্র করছেন, কেউ আগুনের ছেঁকা দিয়ে বাঁশির গায়ে নকশা করছেন। কেউবা নকশা ফুটিয়ে তুলছেন রংতুলিতে।
বাঁশিতে রং করছিলেন গৃহবধূ রিনা বিশ্বাস। তিনি জানালেন, বাঁশি তৈরি ও বিক্রি করেই সংসার চলে। তবে শুধু জীবিকার জন্যই নয়, মনের টান থেকেও এই কাজ করেন তাঁরা।
রিনা বিশ্বাসসহ কয়েকজন জানালেন, শ্রীমদ্দীর অন্তত ৪০টি পরিবার বাঁশিশিল্পে যুক্ত। পরিবারের সব বয়সের নারী, পুরুষ, শিশু—সবাই কোনো না কোনো ধাপে বাঁশি তৈরিতে হাত লাগান।
বাঁশির ধরন: নানা ধরনের বাঁশি তৈরি করেন শ্রীমদ্দীর মানুষেরা। যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস নামের একজন জানালেন, তাঁরা তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, ক্লাসিক্যাল বাঁশি, বিন বাঁশি ও বেলুন বাঁশি তৈরি করেন। তাঁদের তৈরি বাঁশি দেশের বাজার ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, স্পেন, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশে যায়। যতীন্দ্র বলেন, বিদেশে মুখ বাঁশির কদর বেশি। এই বাঁশি একেবারেই প্রাকৃতিক। কোনো রং থাকে না তাতে। আর দেশে চাহিদা বেশি খানদানি বাঁশির। তিনি জানালেন, ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে বাঁশির অর্ডার নিয়ে তা তৈরির জন্য তাঁদের নমুনা সরবরাহ করেন। তাঁরা নমুনামতো তৈরি করে দেন। সরকারি সহযোগিতা পেলে বাঁশি ব্যাপকভাবে বিদেশে পাঠানো সম্ভব বলে মনে করেন যতীন্দ্র।
তৈরির প্রক্রিয়া: একটি বাঁশি তৈরিতে ১৩ থেকে ১৪টি ধাপ থাকে। এটি মূলত মুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় বাঁশিগুলো।
প্রথমে মুলি কেটে শুকাতে হয়। পরে বাঁশের ছাঁচ (ওপরের আবরণ) চেঁছে তুলে ফেলা হয়। তবে আড় বাঁশির ক্ষেত্রে তা করা হয় না। ছিদ্র করার জন্য দাগ কাটা হয়। আড় বাঁশির ক্ষেত্রে কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরি করে আগুন দিয়ে ছেঁকা দেওয়া হয়। এতে বাঁশির গা থেকে মাটি শুকিয়ে পড়ে যায় এবং নকশা ফুটে ওঠে।
বাঁশিতে ছিদ্র করার জন্য বিশেষ ধরনের চোখা সিক ব্যবহার করা হয়। পরে সিরিশ দিয়ে ঘষে মসৃণ করে নিয়ে রং দিয়ে নকশা করা হয়। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল বাঁশি। এরপর প্যাকেট করে বাজারজাত করার পালা।
বেচাকেনা পর্ব: দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা বাঁশি কিনতে ভিড় জমান শ্রীমদ্দীতে। বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে চৈত্র মাসে ক্রেতার ভিড় সবচেয়ে বেশি হয়।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার দীনবন্ধু এসেছেন বাঁশি কিনতে। তিনি বললেন, ‘৪৫ বছর ধইরা শ্রীমদ্দী থেকে বাঁশি কিনা নিয়া বিক্রি করতাছি। যুবকেরাই বাঁশির আসল কাস্টমার। বাচ্চারাও কিনে। এমনও দিন গেছে, মেলায় এক দিনে এক হাজার বাঁশি বিক্রি করা যাইত। অহন বিক্রি কইমা গেছে।’
একেক বাঁশির একেক দাম। প্রবীণেরা বললেন, ব্রিটিশ আমলে একটি বাঁশি এক আনায় বিক্রি করতেন পাইকারেরা।
গোলাম মোস্তফা নামে একজন ক্রেতা এসেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে। জানালেন, একটি বাঁশি কিনতে পাইকারি (হিসেবে) সাড়ে তিন টাকা থেকে দেড় শ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয় ১০ টাকা থেকে কয়েক শ টাকায়।
সুরের কারিগরদের কথা: বাঁশির কদর কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেন এ কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নিরঞ্জন চন্দ্র সরকার, অনিল চন্দ্র বিশ্বাস, যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসসহ কয়েকজন।
অনিল চন্দ্র বললেন, দেশি-বিদেশি প্লাস্টিকের নানা ধরনের খেলনা বাজারে থাকায় বাঁশির কদর আগের চেয়ে কমে গেছে। তারপরও তাঁদের বাঁশি চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেটসহ সারা দেশের ক্রেতারা নিয়ে যান। বিদেশেও যাচ্ছে কিছু। বাঁশির গুণগত মান বাড়িয়ে আরও বেশি পরিমাণে বাঁশি বিদেশে পাঠাতে ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধাসহ সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
যতীন্দ্র চন্দ্র বললেন, চট্টগ্রাম থেকে বাঁশ আনতে হয় তাঁদের। বিশেষ করে কুমিল্লা থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা না দিয়ে বাঁশ আনা যায় না। ফলে তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহমেদ জামিল বলেন, ‘দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে শ্রীমদ্দীর বাসিন্দাদের বাঁশি তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তাঁরা এলে ঋণের বিষয়ে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।’