১১ বছরে তিস্তার চুক্তি না হওয়া লজ্জার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
ফাইল ছবি: বাসস

বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ভারত যখন নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়, তখনো দুই দেশের মধ্যে একটি বিষয় অমীমাংসিতই রয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। ১১ বছর ধরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই না হওয়াটাকে ‘লজ্জার’ বলে অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

গত শনিবার ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য গুয়াহাটিতে নদীবিষয়ক দুই দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সম্মেলনের ফাঁকে তিনি ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিস্তা নিয়ে এ মন্তব্য করেন।

এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে গত ১১ বছরে আমরা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারিনি। আমরা ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি করি। অভিন্ন সব কটি নদীর যৌথ ব্যবস্থাপনায় আমরা বেশ আগ্রহী এবং এ বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। দুই দেশের পুরো অববাহিকার মানুষের কল্যাণের স্বার্থে নদীর পানির যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।’

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটি লজ্জার। আমরা প্রস্তুত, তারাও প্রস্তুত। এখন পর্যন্ত চুক্তিটি সই হয়নি। ভবিষ্যতে পানি নিয়ে বড় সংকট তৈরি হবে এবং এ জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে।’

তিস্তা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের সিকিম অংশে, তারপর এটি সিকিম দিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়েছে এবং সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবেশ করেছে। পরে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে তিস্তার জলাভূমি এলাকাগুলো ভারতকে বরাদ্দ দেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে বিরোধের শুরু হয়।

২০১১ সালে ভারত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি ধরে রেখে তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বণ্টনে রাজি হয়েছিল। ‍কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরম বিরোধিতায় খসড়া চুক্তিটি সই হয়নি। উপরন্তু সিকিমে তিস্তায় অব্যাহত বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে গেছে।

আব্দুল মোমেন বলেন, এ বছর আসাম ও বাংলাদেশ একই সময়ে বন্যার কবলে পড়েছে। তাই নদীর পানির যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধমে দুই দেশ যাতে উপকৃত হতে পারে, এটি মাথায় রেখে উজান থেকে পানি ছাড়ার বিষয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারে আরও সমন্বয় এবং বন্যার পূর্বাভাসে সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে দুই দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

গণমাধ্যমের খবরে চীনের তিব্বতে অবস্থিত ইয়ারলাং সাংপোতে বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে আক্ষেপ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভাটি অঞ্চলের মানুষের স্বার্থ এতে উপেক্ষিত হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চীনের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ ও ভারতের ৬ শতাংশ মানুষ নির্ভরশীল। অথচ ভাটির দেশ বাংলাদেশের ২৩ শতাংশ মানুষ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কারণে দুর্ভোগে পড়ে। আন্তসীমান্ত নদীগুলোর ওপর কোনো দেশের এককভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন করা মোটেই উচিত নয়। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মানুষের কথা আমাদের সবার একসঙ্গে ভাবা উচিত, তা চীনের উন্নয়ন হোক বা ভারত বা বাংলাদেশের হোক। এই পুরো অববাহিকা এবং এখানকার মানুষের ওপর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে।’

চীনের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে আমরা এখনো চীনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব পাইনি। চীন যেটি প্রস্তাব করছিল, তা প্রাথমিকভাবে একটি ফরাসি প্রকল্প ছিল, ১৯৮৯ সালে ফরাসি প্রকৌশলীরা নকশা করেছিলেন। এটি খুব ব্যয়বহুল ছিল, সেই সময় আমরা সেই অর্থ জোগাড় করতে পারিনি। আমি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি, এখন চীন ওই প্রকল্পের একটি অংশ নিচ্ছে, যার নাম তিস্তা প্রকল্প। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো প্রস্তাব পাঠায়নি। আমাদের দেখতে হবে, এটি কীভাবে করা হচ্ছে। কারণ, এখন পর্যন্ত ভারত তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে তেমন কিছু করছে না, তাই তারা (চীন) একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, এটি একটি লোভনীয় প্রস্তাব।’

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের উত্তরাঞ্চলে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মানুষের সুবিধার কথা ভেবে তিস্তার পানির সুব্যবস্থা করার জন্য একটি প্রযুক্তিগত সমীক্ষা চালাতে পাওয়ার চায়না বা চায়না পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চুক্তি করে।

আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তিস্তার বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তাই আমাদের দেশের মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে বিকল্প খুঁজতে চাপ দিচ্ছে। এ কারণে হয়তো তিস্তার বিষয়ে চীনের প্রকল্প নিয়ে গণমাধ্যমে এত আলোচনা হচ্ছে। আমরা খুব আশাবাদী যে ভারত চুক্তিটি করতে রাজি হবে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গও সম্মত হবে। আমরা চুক্তিটি সই করতে পারব।’