১২ অ্যান্টিবায়োটিক এক জীবাণুতে অকার্যকর

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা
ছবি: প্রথম আলো

অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী ‘ইকোলাই’ ব্যাকটেরিয়া অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ৯৮ ভাগ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেই কাজ করতে পারছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এই সাম্প্রতিক গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-এর ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ। গবেষণায় ১২টি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা দেখা হয়।

এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় বিপৎসংকেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ইনফেকশন প্রিভেনশনাল কন্ট্রোল (আইপিসি) বিভাগের সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটিমাত্র ব্যাকটেরিয়া বা ইকোলাই নিয়ে এ গবেষণা হলেও এর মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের একটি চিত্র উঠে এসেছে। এ চিত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় বিপদের সংকেত দিচ্ছে।’

১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক সপ্তাহ পালিত হয়েছে। এই সপ্তাহ পালনের উদ্দেশ্য ছিল অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। ‘সচেতনতা ছড়িয়ে দিন, অকার্যকারিতা রোধ করুন’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সপ্তাহটি পালিত হয়। এরই মধ্যে গত বুধবার এ গবেষণা প্রকাশিত হয়। এ গবেষণার জন্য নমুনা সংগ্রহ হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে।

নর্থ সাউথের গবেষণার তথ্য: গবেষণায় এমোক্সিসিলিন, জেন্টামাইসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নরফ্লক্সাসিন, সেফুরক্সিম, ইমিপেনেম, মেরোপেনেম, ক্লোরামফেনিকল, এজিথ্রোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন, কোট্রাইমোক্সাজল এবং পিপেরাসিলিন-টাজোব্যাক্টাম নামে ১২টি অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ দেখা হয়।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে ইকোলাই ব্যাকটেরিয়ার ওপর ১২টি বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। যেখানে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং বা পূর্ণ জিন নকশা উন্মোচনসহ অত্যাধুনিক গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে এই গবেষণার কাজ। এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসান মাহমুদ রেজা। এই প্রকল্পে আরও কাজ করেছেন সহযোগী অধ্যাপক প্রীতি জৈন ও অসীম কুমার ব্যাপারী।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা প্রাথমিকভাবে ২৫০ জন রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে বাছাইকৃত ১০০টি নমুনা বিশেষভাবে পরীক্ষা করেছেন। জৈব রাসায়নিক পরীক্ষায় ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলো হলো এমোক্সিসিলিন, জেন্টামাইসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নরফ্লক্সাসিন, সেফুরক্সিম, ইমিপেনেম, মেরোপেনেম, ক্লোরামফেনিকল, এজিথ্রোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন, কোট্রাইমোক্সাজল এবং পিপেরাসিলিন-টাজোব্যাক্টাম। পরীক্ষায় দেখা গেছে, নমুনার ৯৮ ভাগ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এমোক্সিসিলিন অকার্যকর। সেফুরক্সিম ও কোট্রাইমোক্সাজলের জন্য তা যথাক্রমে ৭৫ ও ও ৬২ ভাগ।

সেফুরক্মিম ও কোট্রামোক্সাজল অকার্যকর ৭৫-৬২%, ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ২৫০ রোগীর নমুনা সংগ্রহ।

ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ওষুধের অকার্যকারিতা বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে ওষুধ প্রতিরোধী সংক্রমণে বছরে প্রাণ হারাবেন প্রায় এক কোটি মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই হবেন এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের। এসবের মূলে রয়েছে মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক প্রয়োগ এবং সঠিক নিয়মে ওষুধ গ্রহণ না করা। বিপদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক-বিরোধী জিনের ছড়িয়ে পড়া। বিশেষত, ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে বিভিন্ন বিটা-ল্যাকটামেস জিনের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

এ গবেষণা প্রকল্পের প্রধান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হাসান মাহমুদ রেজা বলেন, বিটা-ল্যাকটামেস জিনের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়া বিটা-ল্যাকটামেস নামের উৎসেচক (এনজাইম) তৈরি করে, যা বিটা-ল্যাকটামেস অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন এমোক্সিসিলিন, সেফিক্সিম, সেফেপিম, সেফট্রিয়াক্সন, সেফুরক্সিম, ইমিপেনেম ও মেরোপেনেমকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। কোন কোন জিন অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে তুলছে, তা জানতে উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানীরা পূর্ণ জিন নকশা উন্মোচনের মাধ্যমে এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে খুঁজে বের করছেন, যাতে এই সমস্যা সমাধানের পথ বের করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ ও যৌক্তিক ব্যবহারের জন্য অ্যান্টিবায়োটিককে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। সেগুলো হলো অ্যাকসেস, ওয়াচ এবং রিজার্ভ। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুরু হয় অ্যাকসেস দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় উল্টো ঘটনা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যাকসেস অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই শুরু করা উচিত। কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে বাংলাদেশে শুরুই হয় ওয়াচ ধারার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। এটা খুবই খারাপ ধারার এক প্রবণতা শুরু হয়েছে আমাদের এখানে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোতে অ্যাকসেস গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেশি ওয়াচ গ্রুপ থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অ্যাকসেসের চেয়ে বেশি।’

সংক্রমণ চিকিৎসায় ইমিপেনেম ও মেরোপেনেম অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকদের শেষ ভরসা। নর্থ সাউথের গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২ থেকে থেকে ৩৮ ভাগ নমুনার ক্ষেত্রে এসব অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকও কাজ করছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবাণু ধ্বংস করতে নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং নির্দিষ্ট সময় ধরে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। রোগী যদি তা না করে, তাহলে ওই জীবাণু ওই অ্যান্টিবায়োটিকে মরে না, জীবাণু ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। অ্যান্টিবায়োটিক তখন অকার্যকর হয়ে পড়ে।

আরও যেসব গবেষণা

অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার নিয়ে এর আগে একাধিক গবেষণা হয়েছে। সেগুলোতে দেখা গেছে, দেশে প্রয়োজনের চেয়ে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে যৌথভাবে এক গবেষণা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি। দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি হাসপাতালে করা সেই গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোতে সতর্কভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ে কাজে আসছে না।

গবেষকেরা ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ৭ হাজার ৪৮৫ জন এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাই মাসে ৭ হাজার ৬৫৮ জন রোগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পর্যালোচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে, ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এই তালিকায় আছে সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, ফ্লুক্লোক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সোসিলিন+ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরোক্সিম, মোস্কিফ্লোক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজোল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়োটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ঠিকমতো কাজ করে কি না, তা-ও পরীক্ষা করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা দেখেছেন, সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না। বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের কমবেশি অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ গবেষকেরা পেয়েছেন।

অ্যামোক্সিসিলিন অকার্যকর ৯৮% ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে, ঢাকা শহরের দুটি বেসরকারি এবং একটি সরকারি পরীক্ষাগার থেকে নমুনা সংগ্রহ।

২০ মাস ধরে বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা কম। তবে দেশে করোনাকালে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দেখা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার আইইডিসিআর আয়োজিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারবিষয়ক সেমিনারে এই তথ্য দেওয়া হয়।

ওই অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শও কেউ দেয়নি। তারপরও দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮০ শতাংশ রোগীকে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। অ্যামিকাসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক ২০১৭ সালে ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল, ২০২১ সালে সেই হার বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অ্যাম্পিসিলিন ২০১৭ সালে ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল, এখন তা ৮৬ শতাংশ। এভাবে তিনি ১২টি অ্যান্টিবায়োটিকের উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে এমন কিছু ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে, যা কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে মরবে না।

কেন এই অপব্যবহার

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ওষুধপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের এই যথেচ্ছ ব্যবহার ঘটছে। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি। আর বেশি দামি ওষুধ বিক্রিতে বেশি লাভ। আর আছে এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং অজ্ঞতা। সেটা যাঁরা এর ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁদের এবং এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সচেতনতা দরকার।

ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের বেশি ব্যবহারের সঙ্গে মুনাফার বিষয়টি জড়িত। কেবল মানুষের শুধু সচেতনতা বাড়িয়ে এর যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। চিকিৎসা সেবাদানকারীদের ওপর একশ্রেণির ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনকারীদের অতিরিক্ত চাপ থাকে। স্বীকৃত পেশাজীবীদের বাইরে দোকানদার ও হাতুড়ে চিকিৎসকদের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির প্রবণতা একটা বাড়তি চাপ তৈরি করে।

অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে সচেতনতামূলক কোনো কথা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পাঠ্যক্রমে নেই বলে জানান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একটি সমাজ এই শব্দের সঙ্গে কোনোভাবে পরিচিত না হয়ে কীভাবে এর সম্পর্কে জানবে আর সচেতন হবে। শুধু সরাসরি চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সচেতনতা তো কাজে আসবে না। এটা কোনোভাবেই একটি সমাজকে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে পারে না।’

কী করা উচিত

অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে গবেষকেরা বলেছেন, পরীক্ষাগারে নিয়মিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে। যাতে চিকিৎসকেরা রোগীর জন্য সঠিক ওষুধের নাম ব্যবস্থাপত্রে লিখতে পারেন।

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হাসান মাহমুদ রেজা বলেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, রোগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার কমিয়ে এর প্রতিরোধী পরিস্থিতির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অনতিবিলম্বে সরকারের তরফে আরও তদারকিমূলক, কার্যকর এবং টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রেখে পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি নয়, এর জন্য কঠোর ব্যবস্থার পরামর্শ দেন মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, শুধু উপদেশ দিয়ে কাজ হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারের পক্ষ থেকে এর নজরদারি দরকার।

কোথায় হবে সেই নজরদারি? মুশতাক হোসেনের পরামর্শ, প্রথম দেখতে হবে ওষুধের দোকানগুলোর নিবন্ধন আছে কি না, তা ঠিক করা। যেগুলোর নিবন্ধন নেই, সেগুলোকে এর আওতায় আনতে হবে। এসব দোকান কী পরিমাণ ওষুধ বিক্রি করছে, তার হিসাব রাখবে। এর জন্য প্রতিটি দোকান যান্ত্রিকভাবে এগুলোর হিসাব রাখবে। প্রতিটি প্রেসক্রিপশনের হিসাব রাখবে। আর সেগুলোর পর্যবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার থাকবে।

মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে পশুর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আরও শিথিল বলে মনে করেন অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।