বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌপথ
১৩৬ কোটি টাকা গচ্চার দায় নিচ্ছে না কেউ
ফেরিঘাট নির্মাণের আগে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। ঘাট তৈরি শেষ, এখন ফেরি চালানো যাচ্ছে না।জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাটের নবনির্মিত স্থাপনা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। গত বুধবার দুপুরে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ এলাকাছবি: আবদুল আজিজ
ঘাট তৈরি। নির্মাণ করা হয়েছে নানা অবকাঠামো। খনন করা হয়েছে ২৬ কিলোমিটার নৌপথও। এসব কাজে ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ের পর জানা গেল ফেরি চালানো সম্ভব নয়।
ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ও গাইবান্ধার বালাসী নৌপথ ঘিরে। এ রুটে গত জুন থেকে পুরোদমে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার কথা। প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে আসায় ওই পথ দিয়ে কয়েক দফায় পরীক্ষামূলকভাবে ফেরি চালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এরপর গত এপ্রিলে নৌরুটটির সমস্যা খুঁজে দেখতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) একটি কমিটি করে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যমুনা নদী খুবই পরিবর্তনশীল এবং ঘন ঘন রুট পরিবর্তন করায় দীর্ঘ ২৬ কিলোমিটার নৌপথ সংরক্ষণ করতে বছরে ৩২ থেকে ৩৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করতে হবে।
ফেরি চালাতে হলে এ রুটে সার্বক্ষণিক ছয় থেকে সাতটি ড্রেজার রাখতে হবে। বছরে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্পটি তাঁর সময়ে নেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতুর বিকল্প হিসেবে এই নৌরুটে ফেরি চালানোর জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা দুই-তিনবার পরীক্ষামূলক ফেরি চালানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। এত দিন পর জানা যাচ্ছে, এই রুট ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়।’ তাহলে কীভাবে এই প্রকল্প নেওয়া হলো জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘একটা জরিপ হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়নি। জরুরি বিবেচনায় জরিপের ভিত্তিতেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।’
প্রকল্পের এত টাকা গচ্চা গেল কি না, জানতে চাইলে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রকল্পে এই ধরনের দুর্বলতা থাকে বলেই সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্প না নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন।’
নৌ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এখন সমীক্ষা করে এই রুটে কোন পথে ফেরি চলাচল সম্ভব, তা নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর বাহাদুরাবাদ ঘাট দিয়ে স্পিডবোট ও লঞ্চে যাত্রী পারাপারের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
নদীর গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে বালাশী থেকে বিকল্প পথ হিসেবে বাহাদুরাবাদ ঘাটের পরিবর্তে খোলাবাড়ি, আনন্দবাড়ি ও জিগাবাড়ির ঘাট চিহ্নিত করেছে কমিটি। এই তিন ঘাটের মধ্যে জিগাবাড়িকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটে ফেরি চালানো সম্ভব হলে ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলার এবং উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলার মানুষকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চলাচল করতে হতো না।
সবই আছে, ঘাট সুনসান
সরেজমিনে গত বুধবার দুপুরে দেখা যায়, বাহাদুরাবাদ ঘাটে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনা করা হয়েছে। রয়েছে বিশাল দুটি প্রবেশদ্বার। ভেতরে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, আনসার ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, ফেরির নাবিকদের ব্যারাক, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, জেনারেটর সাবস্টেশন, দুটি বিশ্রামাগার, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, শৌচাগার ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন করতে ফুলের বাগানও করা হয়েছে। তবে পুরো ঘাট এলাকা সুনসান।
প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ার দায় নিচ্ছেন না এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিন পাঠান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রকল্প পাস হয়ে আসার পর পরিচালক শুধু বাস্তবায়নের কাজ করেন।
ফেরিঘাটটির প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার বাহাদুরাবাদ-বালাসী নৌপথ পরিদর্শন করেন। এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে তখনকার নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভায় রুটটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৪ সালের ১২ মার্চ ওই নৌপথ পরিদর্শনে যান শাজাহান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
২০১৬ সালে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে নৌ, সড়ক, স্থানীয় সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেল ও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধিরা এলাকাটি পরিদর্শন করেন। পরে প্রতিবেদন দেওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর ১৩৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়।
ঘাটটির সমস্যা খুঁজতে গঠন করা বিআইডব্লিউটিএর কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘাট নির্মাণের প্রকল্প নেওয়ার আগে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করায় নদীর গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। স্থানীয়দের মতামতও নেওয়া হয়নি। কেবল বিভাগীয় কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সময়ে ড্রেজিং করে নদীতে যে চ্যানেল তৈরি করা হয়েছিল, তা পরিবর্তন হয়ে গেছে। নদীর গতি–প্রকৃতির কারণে প্রতিবছরই এক–দুবার এই চ্যানেল পরিবর্তন হয়ে যাবে।
কেন পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কোনো প্রকল্প কী করে সমীক্ষা ছাড়া হয়?’ মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু ফেরি কেন চলবে না, সেটা বিআইডব্লিউটিএ ভালো বলতে পারবে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে তিনটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমি চলে আসার পর সেগুলো বাতিল করে দিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এই রুট নিয়ে কী করবে, এখন তারাই ভালো বলতে পারবে।’ কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প নিয়ে সরকারি অর্থের অপচয়ের দায় কার, প্রশ্ন করলে ফোন কেটে দেন সাবেক এই মন্ত্রী।
‘টাকাগুলো পানিতে গেল’
ফেরিতে নদী পার হওয়ার সুযোগ আসছে জেনে খুশি হয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন। কিন্তু এখন ফেরি চালানো সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের দুষছেন তাঁরা। বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকার বাসিন্দা ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মুক্তাদীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোটি কোটি টাকা পানিতে গেল। ফেরি চলবেই না, তাহলে ঘাট নির্মাণ করল কেন?’
রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষেরও ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. শাহনেওয়াজ শাহানশাহ্। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘাট নির্মাণের জন্য অনেক মানুষের জমি নেওয়া হয়েছে। ড্রেজিং করার সময় স্থানীয় বহু মানুষের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তারপরও মানুষ ঘাটটি চেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ঘাটে ফেরি চালানো যাবে না, এর জন্য দায়ী কে? কেন পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল?’