৩ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন

হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোকের কারণ উচ্চ রক্তচাপ। সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিয়ে প্রকোপ কমানো সম্ভব।

দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ জানেনই না যে তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। সহজে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হলেও অনেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রক্তচাপ মাপার ব্যবস্থা নেই। একাধিক সরকারি জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এক দশকের বেশি সময় ধরে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলে আসছেন যে দেশে উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। দীর্ঘস্থায়ী এই রোগের চিকিৎসায় প্রায় সারা জীবন ওষুধ সেবন করে যেতে হয়। চিকিৎসা ব্যয় অনেকের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

উচ্চ রক্তচাপ অন্য আরও একাধিক রোগের কারণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হৃৎপিণ্ডের আকার বেড়ে যায়, এই পরিস্থিতিকে ‘হার্ট ফেইলিউর’ বলা হয়। আবার ‘হার্ট অ্যাটাকের’ একটি কারণ উচ্চ রক্তচাপ। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণেরও অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ চোখ ও কিডনির গুরুতর ক্ষতি করে।

মানুষকে সচেতন করে এই রোগের প্রকোপ ও ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আজ মঙ্গলবার ১৭ মে অনেক দেশে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস পালিত হবে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য: নির্ভুলভাবে রক্তচাপ মাপুন, এটি নিয়ন্ত্রণে রাখুন, দীর্ঘায়ু হোন।

দেশের পরিস্থিতি

সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৭–১৮) দেখা গেছে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। উচ্চ রক্তচাপ পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে ১৮ বছরের বেশি জনসংখ্যা ১১ কোটি ১৮ লাখ ৯৬ হাজার। সেই হিসাবে ৩ কোটির বেশি মানুষ এই দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত।

দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হৃৎপিণ্ডের আকার বেড়ে যায়, এই পরিস্থিতিকে ‘হার্ট ফেইলিউর’ বলা হয়। আবার ‘হার্ট অ্যাটাকের’ একটি কারণ উচ্চ রক্তচাপ। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণেরও অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ চোখ ও কিডনির গুরুতর ক্ষতি করে
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া

জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ জানেনই না যে তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশ এই রোগের চিকিৎসা নেন বা ওষুধ সেবন করেন। তাঁদের মাত্র ১২ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা গেছে। অর্থাৎ আড়াই কোটির বেশি মানুষ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, অনেকে রোগ আছে জেনেও চিকিৎসা নিচ্ছেন না। আবার চিকিৎসা নিয়েও অনেকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। ওষুধের দাম, ওষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়া, ওষুধ না পাওয়ার কারণে হয়তো কেউ কেউ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করছেন। আবার এমনও হতে পারে যে অনেকে জানেন না যে ওষুধ দীর্ঘকাল খেয়ে যেতে হবে। দেশে কিডনি রোগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বৃদ্ধিকে মনে করা হয়।

সহজ প্রযুক্তির যন্ত্র ‘স্টেথোস্কোপ’ ব্যবহার করে রক্তচাপ মাপা বা নির্ণয় করা যায়। পরিমাপ করার জন্য বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের ব্যবহার সহজে শেখা সম্ভব। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্র নেই অথবা যন্ত্র ব্যবহার জানেন, এমন জনবল নেই।

‘একজন রোগী উপজেলা হাসপাতালে এলে এক সপ্তাহের ওষুধ দেওয়া হতো। আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলে রোগীদের জন্য প্রতিবারে এক মাসের ওষুধ নিশ্চিত করেছিলাম।’
আলিয়া নাহিদ, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী

যেসব প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রকে উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপ করার দায়িত্ব দেওয়া আছে তাদের অনেকগুলোতে সেই সেবা পাওয়া যায় না। ২০১৭ সালের বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকে এই সেবা পাওয়া যায় না। ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবাকেন্দ্রে এই হার ৩৬ শতাংশ। এনজিওদের ৩৭ শতাংশ ক্লিনিকে রক্তচাপ মাপা হয় না।

এই পরিস্থিতি উচ্চ স্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও দেখা যায়। ৫৭ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে ও ৪৩ শতাংশ জেলা হাসপাতালে রক্তচাপ মাপা হয়। অর্ধেক সরকারি মাতৃ ও শিশুকল্যাণকেন্দ্রে এই ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র জরিপকালে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৫২ শতাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এই সেবা দেখা যায়নি।

দেশের মানুষের রক্তচাপ বিষয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মাধ্যমে। এ বিষয়ে জানতে গতকাল সোমবার কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।

গবেষকেরা কী বলছেন

উচ্চ রক্তচাপ কমানো বা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ৩০টি গ্রামের মানুষ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের একদল গবেষক। গবেষণায় ২ হাজার ৬৪৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন।

এসব ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি গিয়ে রক্তচাপ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি পরামর্শ দিতে মাঠপর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ দিয়ে চিকিৎসকদেরও গবেষণায় যুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণাটি ওই তিনটি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ২৪ মাস পর দেখা যায়, তাঁদের সবারই রক্তচাপ কমেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ গবেষণার সাফল্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়।

টাঙ্গাইল ও মুন্সিগঞ্জ জেলার পাঁচটি করে উপজেলার পাঁচটি করে গ্রামে এই গবেষণা হয়েছিল। এতে যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন রোগী উপজেলা হাসপাতালে এলে এক সপ্তাহের ওষুধ দেওয়া হতো। আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলে রোগীদের জন্য প্রতিবারে এক মাসের ওষুধ নিশ্চিত করেছিলাম।’

আলিয়া নাহিদ আরও বলেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের সারা জীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। সুতরাং রোগী যেন কম ব্যয়ে ওষুধ পেতে পারেন, সে বিষয়টিও চিন্তায় রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহ করতে পারে।