৫০ বছর পর শহীদ বাবার কবরের সন্ধান

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ

বাবা যখন যুদ্ধে যান, শফিকুল আলম তখন ছয় বছরের শিশু। সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছেন, বাবা তাঁর শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোথায়, কবে শহীদ হলেন, কিছুই জানতেন না। এমনকি ৫০ বছরেও বাবার কবরের হদিস পাননি। কিন্তু শফিকুল ছিলেন মরিয়া। নিজের মতো অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) চাকরি করেন। সেই সুবাদে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর সহকর্মীদেরও বলে রেখেছিলেন, তাঁর বাবার কবরের সন্ধান যদি কেউ দিতে পারেন।

অবশেষে সাড়া পেলেন বাউবির পাবনা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে। তিনি একটি বইয়ের সন্ধান দিলেন। বইটি তিনি শফিকুলকে পাঠিয়েও দিলেন। পাবনার সাঁথিয়ায় সব যুদ্ধের ইতিবৃত্ত আছে বইটিতে। সেই বইয়েই লুকিয়ে ছিল শফিকুলের বাবার নাম, আর তাঁর যুদ্ধের গল্প। বই পড়ে সাঁথিয়ায় ছুটে যান শফিকুল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন। এখানেই ডাববাগানের যুদ্ধে শহীদ হন তাঁর বাবা তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সিপাহি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ। এখানেই হয়েছে তাঁর বাবার কবর। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার কবরের সন্ধান পেলেন তাঁর সন্তান, তা–ও ৫০ বছর পর। সেই কবর দেখতেই এবার মাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন শফিকুল। এই বিজয়ের মাসেই স্বজনদের নিয়ে একবার কবর জিয়ারত করে যাবেন।

শফিকুল আলমের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোনাকষা ইউনিয়নের রানীনগর গ্রামে। তিনি জানালেন, তাঁর বাবার কর্মস্থল ছিল নওগাঁয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন কয়েক আগে ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন। বাড়িতে থাকতেই খবর পান, বাঙালি ইপিআর, পুলিশসহ অকুতোভয় মুক্তিসেনারা দলে দলে যুদ্ধে যাচ্ছেন। ইলিয়াসও ঘরে বসে থাকেননি। বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। সেই যে বেরিয়েছিলেন, আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কোনো খোঁজও মেলেনি। শুধু বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন তিনি। কিন্তু কবে, কোথায়, কীভাবে তিনি শহীদ হলেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি পরিবারের সদস্যরা।

বাবা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদের কবর জিয়ারত করছেন ছেলে শফিকুল আলম (সাদা পাঞ্জাবি পরা, ডান থেকে তৃতীয়)। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়ার শহীদনগর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পাবনার সাঁথিয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নিজাম উদ্দিন। ২০১৭ সালে তাঁর লেখা ‘একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়। বইয়ে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। বইয়ের একটি অংশে একাত্তরে ডাববাগান (পরে নাম হয় শহীদনগর) যুদ্ধের ঘটনার বর্ণনাসহ শহীদদের নামের তালিকা রয়েছে। সেখানে গ্রামবাসীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হওয়া ১৭ জন ইপিআর জওয়ানের নাম রয়েছে। নামের তালিকায় সপ্তম নামটি ইলিয়াস আহমেদের। এ ছাড়া যুদ্ধের স্থান, অর্থাৎ শহীদনগরে শহীদদের স্মরণে ‘বীর বাঙালি’ নামের যে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, তাতেও ইলিয়াস আহমেদের নাম আছে।
বই পড়ে শফিকুল মোটামুটি নিশ্চিত হন তাঁর বাবা শহীদনগরের যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন। গত নভেম্বরে তিনি সাঁথিয়ার শহীদনগরে যান। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে নিশ্চিত হন, তাঁর বাবা সেখানেই শহীদ হয়েছেন।

ওই গ্রামে সে সময় তিনটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে গ্রামবাসী শদীদদের গণকবর দিয়েছিলেন। কাছাকাছি অবস্থিত গণকবর তিনটির যেকোনো একটিতে ইলিয়াসকে সমাহিত করা হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তিনটি গণকবরের ঠিক কোনটিতে তাঁর দেহ আছে, তা জানা যায়নি। তাতে আপত্তি নেই শফিকুলের। শহীদনগর গ্রামে বাবার কবর আছে, এটুকু জানতে পেরেই স্বস্তি পেয়েছেন তিনি।

শহীদনগরে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীর সঙ্গে শফিকুল আলম (ডান থেকে চতুর্থ)। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়ায়
ছবি: প্রথম আলো

শহীদনগর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল লতিফ (৭৫) বলেন, ইপিআর সদস্যরা তাঁদের বাড়িতে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের সবাই পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে যুদ্ধের দুই-তিন দিন পর তাঁরা গ্রামে ফিরে দেখেন, এখানে–সেখানে ইপিআর জওয়ান ও গ্রামের লোকজনের লাশ পড়ে আছে। পরে কয়েকটি জায়গায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়। নিহত ইপিআর জওয়ানদের সবার নামই পরে জানা গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ইলিয়াস আহমেদও ছিলেন।
‘একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পাবনা-বগুড়া সড়কের সাঁথিয়া উপজেলার শহীদনগর (তৎকালীন নাম ছিল ডাববাগান) নামক স্থানে সম্মুখ সমরে শহীদ হন ইলিয়াস আহমেদ। সেদিনের যুদ্ধে তিনি ছাড়াও ইপিআরের ১৭ সদস্য ও গ্রামের ১৫ বাসিন্দা শহীদ হয়েছিলেন।

শফিকুল আলম বলেন, ‘৫০ বছর ধরে বাবার কবর খুঁজে ফিরছিলাম। এখন আমাদের পরিবারের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। আজ কিছুটা হলেও শান্তি পাচ্ছি। এই বিজয়ের মাসেই পরিবারের সব সদস্য মিলে আমরা বাবার কবরে গিয়ে দোয়া মাহফিলে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ইলিয়াস আহমেদের স্ত্রী সালেহা খাতুন (৭৬)। স্বামীর কবর দেখার জন্য তিনিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।