৫৫ বেসরকারি মেডিকেলে কারা পড়াচ্ছেন, জানে না অধিদপ্তর

৫৫ বেসরকারি মেডিকেলে কারা পড়াচ্ছেন, জানে না স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। শিক্ষক তৈরিতে সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে তাগিদ।

প্রয়োজনীয় শিক্ষকের নিশ্চয়তা ছাড়াই প্রায় প্রতিবছর নতুন নতুন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন পাচ্ছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের সংকট চলছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষকের নিশ্চয়তা ছাড়াই প্রায় প্রতিবছর নতুন নতুন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন পাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, দেশে চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার এটি বড় একটি কারণ।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ৭৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। তাতে ৫৫টি কলেজের জনবলের কোনো তথ্য নেই। অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, একাধিকবার তাগাদা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। অধিদপ্তর জানে না, এসব কলেজে কারা মেডিকেল শিক্ষা দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শেষ। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হতে যাচ্ছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে জেনে-বুঝে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য আমরা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে কলেজের তথ্য তুলে দিয়েছি।’

কম শিক্ষক থাকার অর্থ, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াই চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে আজকাল যেসব অভিযোগ শোনা যায়, তার একটি কারণ হয়তো এই যে কিছু মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না।
অধ্যাপক ইসমাইল খান, উপাচার্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ১১৬টি। সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য আসনসংখ্যা ৪ হাজার ৩৫০। বেসরকারি ৭৩টি মেডিকেল কলেজে আসনসংখ্যা ৬ হাজার ৩৫৪। ৬টি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে আসনসংখ্যা ৪২৫।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে এটা বোঝা যায় যে অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের তথ্য লুকাতে চায়। তারা বলতে চায় না কোন বিষয়ে কতজন শিক্ষক তাদের আছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে মেডিকেল কলেজগুলো জনবলের তথ্য জমা দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ কলেজ তা দেয় না।

বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রীতি চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘মেডিকেল, নার্সিং—সব ক্ষেত্রেই শিক্ষকসংকট চলছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতেও এই সংকট আছে। শিক্ষক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। আমরা সরকারকে এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।’

চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ চিকিৎসা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। পরিসংখ্যান বলছে, কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সেই অনুপাতে শিক্ষক নেই।

৫৫টি মেডিকেল কলেজে কত শিক্ষক আছেন, তা ওয়েবসাইট থেকে বোঝার উপায় নেই। শিক্ষকদের তথ্যের জায়গায় লেখা আছে: ‘প্রোপার ডেটা নট এভেইলেবল’। অর্থাৎ সঠিক উপাত্ত নেই। কর্মকর্তারা বলেছেন, উপাত্ত চেয়েও পাওয়া যায়নি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

১৮টি মেডিকেল কলেজ তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে আছে: ঢাকার উত্তরা আধুনিক, আদ-দীন উইমেন, ইবনে সিনা ও ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট ও মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লার সেন্ট্রাল, ময়নামতী ও ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, সিলেটের জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া ও নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুরের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন, খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী উইমেন্স এবং মানিকগঞ্জের মুন্নু মেডিকেল কলেজ।

যদিও সুনাম আছে এবং প্রতিষ্ঠিত বলে স্বীকৃত এমন একাধিক মেডিকেল কলেজের নাম এই তালিকায় নেই।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি শিক্ষক আছেন সিলেটের নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই কলেজে ১৫১ জন শিক্ষক আছেন। তবে ওয়েবসাইটে ভুল তথ্যও আছে। যেমন তিনটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা ১০-এর কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কত শিক্ষক চাই

বিএমডিসি বলছে, প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন প্রভাষক এবং ২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক (সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক) থাকতে হবে। প্রতিবছর ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে এবং পাঁচটি শিক্ষাবর্ষ চালু আছে এমন কলেজের জন্য কমপক্ষে ৭৭ জন শিক্ষক থাকা দরকার। প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১০০ জন করে শিক্ষার্থী থাকলে ওই মেডিকেল কলেজে শিক্ষক থাকতে হবে ১৫৪ জন। যে ১৮টি মেডিকেল কলেজ শিক্ষকের তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, এদের কোনোটি বিএমডিসির শর্ত পূরণ করতে পারেনি।

বিএমডিসি একটি আদর্শ অবস্থার কথা বলেছে। চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু তারতম্য মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রয়োজনের অর্ধেক বা তারও কম শিক্ষক দিয়ে মেডিকেল শিক্ষা চলতে পারে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কম শিক্ষক থাকার অর্থ পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াই চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে আজকাল যেসব অভিযোগ শোনা যায়, তার একটি কারণ হয়তো এই যে কিছু মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না।’