৮৭ মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ তদন্তের মুখে

দেশের ৮৭টি বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ সরকারের নীতিমালা মেনে চলছে কি না, তা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ জন্য ২২টি কমিটি গঠন করা হবে।
এ ছাড়া সর্বশেষ দেওয়া ১২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়।
গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে শিক্ষা ও ভর্তি-সংক্রান্ত কমিটির সভায় মন্ত্রণালয় এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘হাম-রুবেলা টিকাদান ক্যাম্পেইন’ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নতুন মেডিকেল কলেজগুলোর অনুমোদন পর্যালোচনা করে দেখা হবে। কেউ যদি এ বছর ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু করেও থাকে, তাহলেও তাকে পর্যালোচনার মধ্যে আনা হবে।
কলেজ তদন্তের উদ্যোগ: নতুন ১২টিসহ দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৬টি। আর বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ২১টি। এই ৮৭টি প্রতিষ্ঠান নীতিমালা মেনে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা হচ্ছে কি না, তা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কর্মকর্তাদের নিয়ে ২২টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি ও কমিটির কার্যপরিধি চূড়ান্ত করবে। ‘খুব শিগগির’ এই কমিটিগুলো কাজ শুরু করবে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এসব কলেজে গড়ে ভর্তি ফি ১৫ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে আসনসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এতে ভর্তি ফি গড়ে ছয় লাখ টাকা।
এসব কলেজে ভর্তি ফি বেশি হওয়ায় এবং ভর্তির স্কোর ১২০ হওয়ায় অনেক আসন (মলিকপক্ষের হিসাবে ৪০ শতাংশ) খালি পড়ে আছে। মালিকপক্ষ ভর্তি ফি না কমিয়ে ভর্তি স্কোর কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। আসন খালি আছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ। কলেজ পরিচালনা করে মনসুর আলী ট্রাস্ট। ট্রাস্টের সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী। ওই কলেজ ও ভর্তি স্কোর কমানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কলেজের স্বার্থে মেধাহীনদের ভর্তি করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
১২ মেডিকেল কলেজের অনুমোদন স্থগিত: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) এ বি এম আবদুল হান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে এসব কলেজের অনুমোদন স্থগিত করার কথা জানানো হবে। এসব কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।
মহাজোট সরকারের একেবারে শেষ সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়। এগুলো হচ্ছে: ঢাকায় কেয়ার মেডিকেল কলেজ (মোহাম্মদপুর), ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ (মহাখালী), ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ (গুলশান) ও ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ (নারায়ণগঞ্জ); চট্টগ্রামে মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, সিলেটে পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), কিশোরগঞ্জে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ, খুলনায় আদ-দ্বিন মেডিকেল কলেজ ও খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ, রংপুরে কছিরুদ্দিন মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহীতে শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ।
অভিযোগ আছে, প্রায় শতভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মেডিকেল কলেজ চালাচ্ছে। নীতিমালায় বলা আছে, ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে মেট্রোপলিটন এলাকায় কলেজের নামে দুই একর জমি অথবা নিজস্ব ভবনে এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের একাডেমিক ভবন ও এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের হাসপাতাল ভবন থাকতে হবে। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে চার একর নিজস্ব জমি অথবা ওপরে বর্ণনা দেওয়া ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে। কোনো ভাড়া বাড়িতে কলেজ করা যাবে না। এ ছাড়া ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫০ শয্যার অবকাঠামো থাকবে এবং নিয়মিত ৭০ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি থাকবে।
মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এসব শর্ত পূরণ না করলেও ১২টি কলেজকে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রভাবশালী আমলা, চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীরা এসব মেডিকেল কলেজের অনুমোদন নেন। কেয়ার মেডিকেল কলেজের মালিক দুজন প্রভাবশালী চিকিৎসক। ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও আদ-দ্বিন মেডিকেল কলেজের মালিক পৃথক তিনটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের পেছনে দুজন প্রভাবশালী আমলা। মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ ও খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজের মালিক প্রভাবশালী সরকারদলীয় চিকিৎসক। কছিরুদ্দিন মেডিকেল কলেজের উদ্যোক্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী। আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ বর্তমান রাষ্ট্রপতির নামে।
ভর্তি শুরু হয়েছে: নতুন ১২টি কলেজের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছয়টি। এই ছয়টি কলেজে ভর্তির অনুমতি দেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদ। তবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা বাকি ছয়টি কলেজে ভর্তি চলছে।
চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি মেডিকেল কলেজে আসন ৫০টি। গতকাল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ২০ জন। এই কলেজের উদ্যোক্তাদের একজন সরকারি কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নীতি মেনেই কলেজ করেছি। দ্রুত তদন্ত করে বিষয়টি সুরাহা করা উচিত। তা না হলে যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ নিয়মিতভাবে সংবাদপত্রে ভর্তির বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে। যোগাযোগ করলে কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালকদের একজন আবু সাঈদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, একজন মন্ত্রী (সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক) এই কলেজের অনুমোদন দিয়ে গেছেন মাত্র কয়েক দিন আগে। অন্য একজন মন্ত্রী এসে অনুমোদন স্থগিত বা বাতিল করলে তা অন্যায় হবে। তিনি বলেন, ‘দরকার হলে আমরা আইনের আশ্রয় নেব।’
বিজ্ঞাপন দিয়ে ভর্তি করানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞাপন দিয়েছে যারা, তাদের অনুমোদনও পর্যালোচনার মধ্যে নেওয়া হবে।
পর্যালোচনায় যদি দেখা যায় প্রতিষ্ঠানগুলো শর্ত পূরণ করেনি, সে ক্ষেত্রে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কী হবে—প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এ বি এম আবদুল হান্নান বলেন, তদন্ত কমিটি পর্যালোচনা করে অনিয়ম পেলে পরে মন্ত্রণালয় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএমডিসির সভাপতি আবু সফি আহমেদ আমিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কমিটিগুলোতে কারা থাকছেন, কমিটির কাজের শর্ত—সবকিছুর ওপর নজর রাখা দরকার। পর্যালোচনা করে কমিটি কী পায়, তাও জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।