'অপারেশন ক্লিন হার্টের' দায়মুক্তি আইন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী

বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের যৌথ অভিযানকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, অপারেশন ক্লিন হার্টে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা যৌথ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন। এমনকি তাঁরা চাইলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারবেন।
২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন পাস হয়। ওই আইনে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, সন্ত্রাস দমন এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ২০০২ সালের অক্টোবরে প্রতিরক্ষা বাহিনী, তৎকালীন বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়। ওই যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সব ধরনের কর্মকাণ্ড (২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত) দায়মুক্ত করার জন্য আইনটি প্রণীত হয়েছে।
যৌথ বাহিনী সারা দেশে ওই সময়ে যে অভিযান চালায়, সেটি অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে পরিচিত ছিল।
গতকাল রায়ে ওই আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আদালত বলেন, জাতীয় সংসদকে সতর্ক থাকতে হবে, যেন সংবিধানের চেতনা পরিপন্থী এ ধরনের আইন প্রণীত না হয়ে যায়। ইচ্ছাধীন হত্যাকে দায়মুক্তি দিতে সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইনটি জন্মগতভাবে মৃত এবং এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই।
২০১২ সালের ১৪ জুন আইনটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়েছিলেন। আইনটিকে কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং যৌথ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে কেন ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা ওই রুলে জানতে চাওয়া হয়। আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রসচিব, সেনা সদর দপ্তরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ছয় সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
এরপর সরকারের পক্ষ থেকে রুলের জবাব দেওয়া হয়। রুল শুনানি শেষে গতকাল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রুল আংশিক মঞ্জুর করে আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের আরজি খারিজ করেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু।
রায়ে আদালত বলেন, যৌথ বাহিনীর যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন। তবে তাঁদের পৃথক মামলার মাধ্যমে আসতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু জঘন্যতম অপরাধ উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে কেউ সংবিধানের ঊর্ধ্বে নন। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ংকর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে।
যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনের ৩ ধারা অনুসারে, ওই অভিযানকালে শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দেওয়া আদেশ বা কাজের ফলে কারও প্রাণহানি বা জান-মালের ক্ষতি হলে, কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে বা কেউ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা অন্য কোনোভাবে সংক্ষুব্ধ হলে সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না বা আইনগত কার্যক্রম চালানো যাবে না।
রায়ের পর শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, ওই আইনের ফলে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ের ফলে আরেকবার প্রমাণিত হলো, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। এ ছাড়া হাইকোর্টের রিট বেঞ্চে গিয়ে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার যে অধিকার আদালত দিয়েছেন, সেটাও এর আগে কখনো হয়নি।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, প্রায় চার মাসব্যাপী ওই অপারেশন ক্লিনহার্টে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তবে যৌথ বাহিনীর দাবি, নিহত ব্যক্তিরা সবাই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।