'আমাদের দুঃখের কোনো শেষ নাই'
ঘরের ভেতরে কাদা। কোথাও জমে আছে পানি। ঘরে ঢোকার জো নেই। ময়লা-আবর্জনায় ছেয়ে যাওয়া ঘরগুলো যেন পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। বাইরে অবস্থান করে বাসিন্দারা সবাই এসব দেখছেন, আর মাঝেমধ্যে ক্ষোভ আর দুঃখ প্রকাশ করছেন।
কুড়িগ্রাম থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পূর্বে রৌমারী উপজেলা। এ উপজেলার বন্দাবের ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি ঘরের অবস্থা এখন এমনই। প্রায় এক মাস বন্যার পানির সঙ্গে লড়াই করে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে এ ঘরগুলোর হতদরিদ্র মানুষগুলোকে। এখন পানি নেমে গেছে, কিন্তু লড়াই থামেনি, কমেনি কষ্ট। স্বচক্ষে ঘরবাড়ির দুরবস্থা দেখা ও বাইরে রাত্রিযাপনের বেদনা তো আছেই, সঙ্গে আছে আবারও বন্যাকবলিত হওয়ার আতঙ্ক। পানি নেমে গিয়ে নদীর স্রোত বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙনের আশঙ্কাও। শুধু ঘর নয়, সড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পুরো এলাকায় পড়েছে কষ্টের ছায়া।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরে ক্ষতির তালিকা তৈরি হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা। কুড়িগ্রাম থেকে নৌকায় চড়ে রৌমারীর উদ্দেশে যাত্রা। তিন ঘণ্টা পর নৌকা গিয়ে পৌঁছাল রৌমারী ঘাটে। সেখান থেকে পাকা সড়ক ধরে মোটরসাইকেলে রৌমারী সদর উপজেলা। এ পথটিই রৌমারী যাতায়াতের একমাত্র পথ। পথে দেখা গেল, কোথাও কোথাও বন্যায় পাকা সড়ক ভেঙে প্রস্থ কমে গেছে। মোটরসাইকেল চালানো দায়। অনেক কষ্টে অবশেষে বন্দরের গ্রাম। এসে চোখে পরে নদী ওপর বাঁশের সাঁকো। হেঁটে পার হতে ভয় লাগে। উঠলেই দোলনার মতো দুলতে থাকে। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ পারাপার করছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘গত বছর বন্যায় সেতুটি দেবে যায়। নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তাই এই বাঁশের সাঁকো। মানুষ কষ্ট করেছে, দেখার কেউ ছিল না। এবারের বন্যায় এ কষ্ট দ্বিগুণ। এবারের প্রত্যাশা, কেউ তাঁদের কষ্টটা বুঝবেন।’
বন্দাবের ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু ঘর কিংবা রাস্তাঘাট নয়। স্কুল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনো জমে আছে পানি। কথা হয় কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা মোড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হজরত আলীর সঙ্গে। বন্যায় এমন দশায় চোখে-মুখে ক্ষোভ তাঁর। আছে কষ্টও। বললেন, ‘বেকেই তো দেখতাইছেন। এইডা কি উপজেলার অবস্থা! বানে রাস্তাঘাট ভাইঙা, পানি উইঠা, মেছমার কইরা দিয়া গ্যাছে। সড়ক ঘরবাড়ি অফিসে ময়লা–আবর্জনা ও কচুরি পানা জইমা আছে।’
হজরত আলীর পাশেই বসে ছিলেন একই উপজেলার বাসিন্দা মোকসেদ আলী। বসে বসে চিন্তা করছেন, কীভাবে ত্রাণের চালের বস্তা ঢুকবে তাঁর গ্রামে। তিনি বললেন, ‘রৌমারী ঢোকার হগল সড়ক জাগায় জাগায় ভাইঙ্গা আছে। রিলিফের চাউলের বস্তা আনুম, হেই উপায় নাই। গাড়ি চলে না। উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়ন গুইলার সকল কাঁচা পাকা সড়ক প্রায় স্থানে ভাইঙ্গা আছে। খুব দুরবস্থা।’
ওই বাঁশের সাঁকো পার হয়ে কলেজ মোড়। এখান থেকে মূল শহরে প্রবেশের দুটি সড়ক। একটি কলেজ পাড়া ও অন্যটি রৌমারী থানার সামনে দিয়ে। কলেজ মোড় থেকে থানা সড়কের অবস্থাও বেশ করুণ। বিভিন্ন স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙে যাচ্ছে। শহরে শাপলা চত্বরের আশপাশে সড়কে কাদা ও পানি জমে আছে। কচুরি পানাও চোখে পড়ে। লোকজন পরনের কাপড় উঁচু করে হাঁটা-চলা করছে। মোড়ের দিকে যেতেই হাত উঁচিয়ে ডাকলেন একজন। তাকিয়ে দেখা গেল, তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য রুহুল আমিন। তিনি বললেন, ‘কলেজ রোড দিয়ে যাওয়া যাবে না। পানি উঠে জায়গায় জায়গায় খাদের সৃষ্টি হয়েছে। শহীদ মিনারের পেছনে চার মিটার সড়কও ভেঙে গেছে।’
বিদায় নিয়ে সামনে এগোতেই দেখা গেল সড়কে কচুরিপানা। কোথাও খাদ। পানি জমে আছে। শহীদ মিনারের কাছে যে সড়ক ভেঙে যাওয়ার কথা বলেছিলেন সংসদ সদস্য, তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পানি। দুই পারে দুটি ভেলা। একটি যাওয়ার, একটি আসার। নারী-পুরুষ ও শিশুরা ঝুঁকি নিয়ে কলাগাছের ভেলায় পারাপার হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির উদ্দিন বললেন, ‘শুধু সড়ক নয়, শহীদ মিনারটি হুমকির মুখে। যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে।’
এই এলাকার বিভিন্ন বেসরকারি কার্যালয়, ক্লিনিক, হোটেল, স্কুল-কলেজ ও আবাসিক ভবনেও জমে ছিল পানি। সমবায় ও আনসার ভিডিপি কার্যালয়ে যাওয়ার পথটিও কয়েক স্থানে ধসে গেছে। খাদ্যগুদামের পেছনে সড়ক কিছুটা দেবে গেছে। সেখানে পানি জমে আছে। সিজি জামান স্কুল ও স্টাফ কোয়ার্টারের পেছনে শহীদ মিনার থেকে সড়কটি বিভিন্ন স্থানে ফেটে ও দেবে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রৌমারী উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সংযোগ সড়কের ১৯টি স্থানে ভেঙে গেছে। জানতে চাইলে রৌমারী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলাম ওরফে সালু বলেন, ‘রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ।’
সন্ধ্যার দিকে রৌমারী উপজেলা থেকে ফেরার সময় কথা হয় আনিছুর রহমান নামের এক বাসিন্দার সঙ্গে। বর্ণনা করছিলেন বন্যায় পুরো এলাকার কষ্টের কথা। একসময় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আমাদের দুঃখের কোনো শেষ নাই।’