'উৎসব সবাইকে একত্র করে'

লক্ষ্মীবাজারের পবিত্র ক্রুশের গির্জায় ক্রুশবিদ্ধ যিশু l ছবি: লেখক
লক্ষ্মীবাজারের পবিত্র ক্রুশের গির্জায় ক্রুশবিদ্ধ যিশু l ছবি: লেখক

বছর ঘুরে আবারও এলো বড়দিন। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা সারা বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। বড়দিনের মূল উৎসব সাধারণত গির্জাকেন্দ্রিক, প্রায় সব গির্জাতেই একই রকম উৎসব হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু গির্জার অনুষ্ঠানে স্বকীয়তা থাকে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত নির্দিষ্ট গির্জায় বড়দিনের প্রার্থনায় যোগ দেন। এরপর তাঁরা অন্যান্য গির্জায়ও যান। ঢাকার প্রাচীন গির্জাগুলোর মধ্যে তেজগাঁওয়ের পবিত্র জপমালা রানীর গির্জা অন্যতম। ইতালীয় বণিক পর্যটক লুদোভিকো দি’ভ্যার্থেমা বা ভের্তেমেন্নুস ও ড. জেমস টেলরের বিবরণ অনুযায়ী তেজগাঁও ধর্মপল্লির যাত্রা শুরু হয় ১৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। 

১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত পুরাতন গির্জাঘরটির স্থাপত্য প্রণালি অনেকটা রোমীয়-পর্তুগিজ মিশ্রিত। এর দুই সারিতে মজবুত ১২টি চুন-সুরকির স্তম্ভ রয়েছে, যা যিশুর ১২ জন শিষ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। উপরিভাগে তিনটি ক্রুশ আছে, মাঝে মা মারিয়ার মূর্তি শোভা পাচ্ছে। মনে হয়, কে যেন শূন্যের ওপরে চারদিকটা আলোকিত করে মন্দিরের পাথরের দেয়ালের ওপর আলোর একটা সিঁড়ি গেঁথে দিয়েছে। দুপাশে বিশাল উঁচু থামের মতো বেদির দেয়ালে খয়েরি রঙের ভাস্কর্যে শিল্পদক্ষতার ছাপ ছিল, যাতে পরবর্তীকালে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়।
অতীতে এই গির্জার বড়দিন উদ্যাপনে যথেষ্ট ভাবগাম্ভীর্য ছিল। ভক্তি, শ্রদ্ধা নিয়ে আচার পালন করা হতো। এ ছাড়া তেজগাঁও ধর্মপল্লিতে আগে বিদেশি খ্রিষ্টভক্তের সংখ্যা, বিশেষ করে পর্তুগিজ ও জার্মানিদের সংখ্যা বেশি ছিল। তাই বড়দিনের খাবারেও ওই দেশের খাবার প্রাধান্য পেত। খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করা হতো ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায়। বিদেশি ব্যবসায়ীদের ঘাঁটি এই তেজগাঁওয়ে থাকায় বড়দিনের আয়োজন হতো বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। তবে এখন তেজগাঁওয়ে বড়দিন উদ্যাপন করা হয় পুরোপুরি বাঙালি সংস্কৃতিতে। খ্রিষ্টযাগ দেওয়া হয় বাংলায়।

তেজগাঁওয়ের পবিত্র জপমালা রানির গির্জা l ছবি: লেখক
তেজগাঁওয়ের পবিত্র জপমালা রানির গির্জা l ছবি: লেখক

বাংলাদেশে খ্রিষ্টধর্মের আগমনের বয়স ৫০০ বছরের বেশি হলেও এর প্রচার ও প্রসার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে লক্ষ্মীবাজারের পবিত্র ক্রুশের গির্জা থেকে। এই ধর্মপল্লির কার্যক্রম ১৮৬৮ সালে শুরু হয়। শুরুতে এই গির্জা ছিল বিভিন্ন সন্ন্যাসব্রতী সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। এখান থেকে সারা দেশের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। পরবর্তী সময়ে পবিত্র ক্রুশ যাজক সংঘ এই ধর্মপল্লির দায়িত্ব গ্রহণ করে। সংঘের নির্দেশে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বেলজিয়ান যাজক গ্রেগরি দ্য গ্রেটের পরিচালনায় পবিত্র ক্রুশের গির্জাঘরটি নির্মিত হয়। তবে এই গির্জা শুরুতে ক্যাথেড্রাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে এখান থেকে ১৯৫২ সালে সেন্ট পল গির্জা, নারায়গঞ্জ ও ১৯৫৬ সালে সেন্ট মেরি’স রমনা ক্যাথেড্রাল নামে দুটি ধর্মপল্লির সৃষ্টি হয়। এই ধর্মপল্লিকে স্থানীয় খ্রিষ্টভক্তরা মায়ের সঙ্গে তুলনা করেন। কারণ এই মা থেকেই সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুল, সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ এবং উল্লেখিত দুটি ধর্মপল্লির জন্ম। এ ছাড়া শুরুর দিকে এখান থেকেই ব্রতধারী-ব্রতধারিণীরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। ২০১৮ সালে এই ধর্মপল্লির ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে।
পবিত্র ক্রুশের বর্তমান গির্জাঘরটি ফরাসি-গথিক শৈলী রীতিতে নির্মিত। এই ধর্মপল্লির প্রথম গির্জাঘরটি এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়। পরবর্তীকালে পুরোনো গির্জার বারান্দার জায়গায় নতুন গির্জাঘর তৈরি করা হয়। তখন গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল অনেকটা চতুষ্কোণ কবরাকৃতির মতো, যার ওপরে অষ্টভুজাকার গম্বুজ টাওয়ার রয়েছে। বেদির পেছনে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর দুপাশে মা মারিয়া ও সাধু যোহনের উপস্থিতি ক্রুশের ওপর যিশুর যাতনাভোগের চিত্রকে ফুটিয়ে তোলে।

রমনা সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল গির্জা l ছবি: লেখক
রমনা সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল গির্জা l ছবি: লেখক

বড়দিন বা যিশুখ্রিষ্টের জন্মোৎসবের মূল অনুষঙ্গ ধর্মীয় রীতি-নীতি। গির্জা প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী নানান আয়োজন হতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লটারি, খেলাধুলার পাশাপাশি বড়দিনের উপহার আদান-প্রদান ছিল প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে লক্ষ্মীবাজারের মানুষের বড়দিন উদ্যাপনেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো খ্রিষ্টান বাড়িওয়ালারাও আর নেই। স্থায়ী সদস্যের সংখ্যাও অনেক কম। যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই জীবন ও জীবিকার তাগিদে আসা জনসাধারণ। তাঁরা বড়দিন এলেই নিজ গ্রামের বাড়ি চলে যান।
রমনা এলাকার সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রাল গির্জা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়। একসময় রমনা গির্জা অনেক প্রাণবন্ত ছিল। বড়দিন উদ্যাপনেও ছিল জমকালো আয়োজন। সেখানে প্রচুর খ্রিষ্টভক্ত ছিলেন। তাঁদের বাড়ি বড়দিন উপলক্ষে নানাভাবে সাজানো হতো। একজন অন্যজনের সঙ্গে উপহার আদান-প্রদান করতেন। ছোট শিশুরা খ্রিষ্টের জন্মসংক্রান্ত নাটিকা উপস্থাপন করত। পারিবারিক সম্মেলন হতো। ২৫ ডিসেম্বরের কিছুদিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি কীর্তন হতো। আর বড়দিনের দিন গির্জাকে ঘিরে থাকত নানা আয়োজন।
কিন্তু বর্তমান পরিবেশ ও যাতায়াতব্যবস্থার কারণে সব বদলে গেছে। মানুষ ধীরে ধীরে নতুন ঢাকার দিকে ধাবিত হচ্ছে। রমনায় এখন উদ্যাপনের কলরব খুবই কম। তবে বড়দিনের আগে এখনো বাড়ি বাড়ি ঘুরে কীর্তন করা হয়। কিন্তু ঘরবন্দী কীর্তনে আর সেই আগের আমেজ নেই। তবে ২৪ ডিসেম্বর রাতে খ্রিষ্টযাগের পরে সবাইকে একত্র করে ‘ক্রিসমাস কেক’ কাটা হয়। সেই কেক সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়া হয়। আর এই গির্জায় যে যিশুর জন্মস্থানের আদলে যে গোশালা নির্মাণ করা হয় তা দেখতে অনেকেই এখানে আসেন।
সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল গির্জার পালক পুরোহিত ফাদার খোকন গমেজ বলেন, উৎসব মানুষের সামগ্রিক জীবনে সারা জাগায়। এটা শুধু নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক নয়, এর বাইরেও সবাইকে যুক্ত করে। এর জন্যই বড়দিনে অনেকেই গির্জা পরিদর্শনে আসেন এবং তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতা, এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই তার আগ্রহ তৈরি হয়। তাই উৎসবকে উদারভাবে দেখলে তা সবাইকে একত্র করে।’
ড্রিঞ্জা চাম্বুগং: প্রদায়ক, প্রথম আলো