'এই দিনডা দেহুনের লাইগা আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখছে'

‘আমি তহন ছয় মাসের পোয়াতি (গর্ভবতী)। পাক সেনারা চোখের সামনে গুলি কইরা আমার স্বামীডারে মাইরা ফালায়। জানুয়ারগরের অত্যাচারে পেটের বাচ্চাডাও নষ্ট অইয়া যায়। এরা চইলা গেলে নিরুপায় অইয়া গোছুল ছাড়াই স্বামীরে উডানে (বাড়ির আঙিনায়) কব্বর দিছি। পরে দুই পুলাপান লইয়া অসুস্থ সইলে গ্রাম ছাড়ি। কম বয়সে বিধবা অইছি, স্বামীর আদর কি জিনিস বুঝবার পাই নাই। তারাও বুঝব বিধবা অয়নের কি কষ্ট।’
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সোহাগপুর গ্রামের বিধবাপল্লির বাসিন্দা জোবায়দা খাতুন (৬৫) এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তাঁর বাড়িতে প্রথম আলোর প্রতিবেদককে এসব কথা বলার সময় তাঁর চোখ ছল ছল করে ওঠে।
জোবায়দা খাতুনের নিজের কোনো বাড়ি নেই। ছেলের বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী মইরা যাওয়নের পর ২২ দিন জাউ খাইয়া থাকছি। ভাতের অভাবে মেয়েডা মইরা যায়। পরে অসুস্থ সইল লইয়া বাড়ি বাড়ি কাম করছি। শেষে ভিক্ষা কইরা চলছি। শুধু এই দিনডা দেহুনের লাইগা আল্লাহ আমগরে বাঁচাইয়া রাখছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসি অইব এই খবরেই আমরা বিরাট খুশি অইছি। কামারুজ্জামানের ফাঁসি অইলে আমার স্বামী-সন্তানের আত্মা শান্তি পাইব।’
একাত্তরের ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ করে। বেনুপাড়ার সব পুরুষকে (১৮৭ জন) হত্যা করে পাড়াটিকে পরিণত করা হয় বিধবাপল্লিতে। সেদিন যে ৫৭ জন বিধবা হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে জোবায়দাসহ ৩০ জন এখনো বেঁচে আছেন।
একাত্তর সালে সোহাগপুর গ্রামের স্বামীহারা আরও কয়েকজন নারীর চোখে দেখা গেছে আনন্দাশ্রু।
একাত্তরে স্বামীহারা করফুলি বেগম (৭০) বলেন, ‘সাক্ষী দেওয়ার পর থাইকা রাতে ঘরের চালে কে বা কারা ডেল মারত। এলাকার লোকজন ডর (ভয়) দেহাইত। সরকার বইদলা (পরিবর্তন) গেলে নাহি, আমগর উল্ডা বিচার করব। এর লাইগা সবসুমু ভয়ে ভয়ে থাকতাম। ফাঁসির রায় বহাল থাহায় আমগর মনে স্বস্তি ফিইরা আইছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসি অইলে আমগর আত্মা শান্তি পাইব।’