'এটি একটি ভালো কাজ হয়েছে'

মীনা কার্টুন তৈরির পেছনে রয়েছে অনেক মানুষের ভাবনা, পরিকল্পনা ও শ্রম। তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসে আজকের মীনার সৃষ্টি। আজ আমরা তাঁদের কয়েকজনের কথা শুনব।

মুস্তাফা মনোয়ার,চিত্রশিল্পী
মুস্তাফা মনোয়ার,চিত্রশিল্পী

মুস্তাফা মনোয়ার
চিত্রশিল্পী

আগে আমি একটি পুতুলনাচের অনুষ্ঠান করতাম। সেখানে পারুল নামের একটি চরিত্র ছিল। পারুল লেখাপড়া করে, গান গায়। সাত ভাই চম্পা থেকে পারুল নামটি নিয়েছিলাম। পারুল নামের সেই পুতুলনাচের অনুষ্ঠান নিয়ে আমার চিন্তা ছিল যে একটি বোন সাত ভাইকে জাগাতে পারে। এই অনুষ্ঠান দেখে ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা আমাকে বললেন, ‘আমরাও মেয়েশিশুদের সচেতনতা ও শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠান করছি।’ এভাবেই মীনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। পরে মীনার নানা পরিকল্পনায় আমি অংশ নিয়েছি। মীনার চরিত্র নিয়ে কাজ করেছি। সব মিলিয়ে এটি একটি ভালো কাজ হয়েছে।

রফিকুন নবী
রফিকুন নবী

রফিকুন নবী
চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট

মীনা পর্বটি শুরু করার সময় ইউনিসেফ আমাদের দেশের যাঁরা যাঁরা কার্টুন আঁকতে পারেন, এমন কয়েকজনকে ডেকেছিল। তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাদের সবাইকে আলাদাভাবে মীনা চরিত্রটি আঁকতে বলা হয়। সে সময় গ্রামের মেয়েরা শাড়িই বেশি পরত। অন্য পোশাকের প্রচলন একেবারেই কম ছিল। আমার চিন্তায় ছিল বাঙালি এক মেয়েশিশুর চিত্র। সেই চিন্তা থেকে আমি এঁকেছিলাম একটি ছোট্ট মীনাকে, যে শাড়ি পরা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন মীনাকে চূড়ান্ত করা হলো, তখন দেখি ভিন্ন পোশাকের মীনা। আমার মনে হয়েছে, ওই পোশাকে কোনো বাঙালিয়ানার ছাপ রাখা হয়নি। তাই মীনাকে দেখে কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছি। কিন্তু সমাজে মীনার প্রভাব অসামান্য। মীনাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করায় গ্রামগঞ্জে এটি অনেক জনপ্রিয়তা পায়। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মেয়েশিশুদের সমস্যাগুলো একই ধরনের হওয়ার কারণে এটি আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমি মনে করি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মীনা কার্টুন তৈরি করা হয়েছে, তা সফল হয়েছে।

তাহমিনা হোসেন
তাহমিনা হোসেন

তাহমিনা হোসেন
সাবেক সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

আমি যখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম, তখন মীনা কার্টুনের বিষয়টি জেনেছি। সে সময় এই প্রকল্পে যতটুকু সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা দিয়েছি। মীনা এমন একটি চরিত্র, যে শিশুদের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরবে, তা শুনেই আমার ভালো লেগেছিল। একটি শিশুকে যেন ছেলে বা মেয়ে নয়, শুধু শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এই ধারণার ব্যাপকতা পায় মীনার মাধ্যমে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মীনার ভূমিকা সত্যিই অতুলনীয়।

শামসুদ্দিন আহমেদ
শামসুদ্দিন আহমেদ

শামসুদ্দিন আহমেদ
সাবেক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ

আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে মীনা কার্টুন তৈরির সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। মীনা দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর শিশুদের কথা মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালকে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের দশক ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল এটি প্রসারের দায়িত্ব নেয়। সে সময় ডেনমার্ক সরকার দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সরকারকে বলল, অ্যানিমেশন কার্টুন তৈরির জন্য তারা অর্থসহায়তা দেবে। কোনো দেশই রাজি হয় না। কেবল বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে রাজি হলো। তখন ইউনিসেফের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান ছিলেন কানাডীয় নাগরিক নিল ম্যাককি। তিনি আমাকে বললেন পরিকল্পনা করতে। এরপর আমি একটি পরিবারের কথা চিন্তা করলাম। একটি মেয়ে, ছেলে, বাবা, মা, দাদি—এই চরিত্রগুলো তৈরি করলাম। নাম কী দেব; ভাবতে ভাবতে মনে হলো, এমন একটা নাম দেওয়া উচিত, যা এ অঞ্চলের সব দেশের মানুষই গ্রহণ করবে। মীনা নামটা সহজ—এ জন্য এই নাম আমি দিয়েছিলাম।তখন এ ধরনের অ্যানিমেশন কার্টুন আমাদের দেশে করা যেত না। মুম্বাইয়ের রামমোহনকে বলা হলো। প্রতিটি চরিত্রের পোশাক কী হবে, তাদের অবয়ব কী হবে, সেগুলো আঁকলেন রামমোহন। মূলত আমাদের পরিকল্পনা আর গল্প; সেই সঙ্গে রামমোহনের আঁকা চরিত্রগুলো চিত্রায়ণ করে মীনা কার্টুনের প্রথম পর্ব ‘মুরগিগুলো গুণে রাখ’ ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হানা বারবারায় তৈরি করা হলো। আরও কয়েকটি পর্ব এখানে তৈরি হলো। এরপর মীনা কার্টুন মুম্বাইয়ের রামমোহন স্টুডিওতে তৈরি হলো। এখন বাংলাদেশেই মীনা কার্টুন তৈরি হচ্ছে।

এর সার্থকতা হচ্ছে এখানেই যে মীনা এখন দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের শিক্ষার বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করছে। আর বর্তমানে মীনা তার চরিত্র ছাড়িয়ে অনেকের জীবনে কাজ করছে। মূলত মানুষের জীবনের সব সমস্যা সমাধানের দূত হিসেবে মীনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মীনা কার্টুন তৈরিতে আরও যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন র‌্যাচেল কার্নেগি। মীনার প্রথম পর্ব তৈরির মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ এই নারীকে ইউনিসেফের মীনা প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কাজ করেছেন নুজহাত শাহজাদি ও ভারতের মীরা আঘি। এঁদের অবদান অনেক।

মীরা মিত্র
মীরা মিত্র

মীরা মিত্র
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ

মেয়েশিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে এবং তাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য পরিবার ও সমাজে একটা আবেদন সৃষ্টি করতে মীনা তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ বাংলাদেশে মীনার এই ২১ বছরের সাফল্য খুঁজতে গেলে অবশ্যই দেখব, আমাদের মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে, মেয়েশিশুদের স্কুলে ভর্তির হার এবং পঞ্চম শ্রেণী পাস করার হার অনেক গুণ বেড়ে গেছে। একইভাবে মীনা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে, যৌতুকের বিরুদ্ধে, মেয়েদের ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে পরিবার ও সমাজকে সচেতন করেছে একজন সফল অ্যাডভোকেট হিসেবে।