'কহর দরিয়া' তুরাগের প্রাণ ফিরবে কি

এ পানি দেখে কি নদীর পানির মনে হয়। ছবি: আব্দুল আলিম
এ পানি দেখে কি নদীর পানির মনে হয়। ছবি: আব্দুল আলিম

কয়েকমাস আগে তুরাগ নদী নিয়ে একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম। সেখানে নদীর তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ড্রেজিং ব্যবস্থা দেখে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে নদী হয়তো আস্তে আস্তে আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

আজ আবার কলম ধরলাম। কারণ নদী দূষণের ব্যপারটা তুলে না ধরলেই নয়।

রাজধানী গাবতলীর কাছে পালপাড়া ঘাট থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত পানির অবস্থা এমন। ছবি: আব্দুল আলিম
রাজধানী গাবতলীর কাছে পালপাড়া ঘাট থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত পানির অবস্থা এমন। ছবি: আব্দুল আলিম

কয়েকদিন আগেই রাজধানী গাবতলীর কাছে পালপাড়া ঘাট থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত বেশ সময়ব্যাপী একটা ট্যুর দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য- নিজ চোখে এবং কাছে থেকে নদী দূষণ প্রত্যক্ষ করা। প্রথমেই পালপাড়া ঘাটে দেখলাম বিশাল এক পাইপের মাধ্যমে কিভাবে ড্রেনের ময়লা পানি ও বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। পানি এখানে এতটাই দূষিত যে তীরের পাশের ইটগুলো পর্যন্ত কালোরঙ ধারণ করেছে। পাশাপাশি দুর্গন্ধের তীব্রতার কথা না বললেই নয়। একটু এগোতেই দেখলাম নদীর পাশে লাউশাক, সিম এগুলোর সারি সারি মাচা। এগুলো খাওয়া কতটা স্বাস্থ্যকর তা আমার ভাবনার উদয় করল। বেশকয়েকজন নারীকে দেখলাম এই কালো পানি দিয়েই কাপড় ধুচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো শিশুরা এই নদীর আশেপাশে চরম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খেলাধুলা করছে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির নির্দেশক।

বালুবাহী কার্গোসহ নানা যান থেকে কি পরিমাণ তেল-বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে তা ধারণার বাইরে। ছবি: আব্দুল আলিম
বালুবাহী কার্গোসহ নানা যান থেকে কি পরিমাণ তেল-বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে তা ধারণার বাইরে। ছবি: আব্দুল আলিম

এরপর সামনে বেদেরটেক ঘাটের পাশে দেখলাম বিশাল বিশাল ময়লার স্তুপ। নৌকার মাঝি স্থানীয় হওয়ায় তিনি জানালেন এর জন্য সাধারণ মানুষই দায়ী।
আরেকটু এগিয়ে যা দেখলাম তার কথা না বললেই নয়। কাউন্দিয়া ঘাট ও তার আশেপাশে নদীর তীরে এক সঙ্গে চলছে মানুষ এবং ছোট ছোট চতুষ্পদ জন্তুগুলোর নিত্য আনাগোনা! মানুষ এখানে পায়ে হেঁটে নৌকায় উঠছে আর ওরা নদীর পাড়ের ময়লার স্তুপে দল বেঁধে খাবার খুঁজছে!

এখানে কথা হল বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। শান্ত নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানালেন তার নিত্য দূর্ভোগের কথা। তার ভাষ্যমতে স্থানীয় প্রশাসনকে বার বার এ ব্যাপারে জানানো হলেও তারা নদী রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। স্কুল পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থী জানালেন প্রতিদিন এই নদী পাড়াপাড়ে তার অনেক কষ্ট হয়। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।

তুরাগের পানি থেকে আসে তীব্র দুর্গন্ধ। ছবি: আব্দুল আলিম
তুরাগের পানি থেকে আসে তীব্র দুর্গন্ধ। ছবি: আব্দুল আলিম

নদীর পাড়ের ময়লার স্তুপগুলোর পর এবার আসি বালুবাহী কার্গোর কথায়। প্রতিনিয়ত এসব যানবাহন থেকে কি পরিমাণ তেল-বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে তা ধারণার বাইরে।

‘জীবন্ত সত্ত্বা’ ঘোষিত এবং একসময়ের ‘কহর দরিয়া’খ্যাত তুরাগ নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত ৬২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এই নদীতে একসময় চলত বিখ্যাত নাবিক আর পি সাহার বড় বড় বাণিজ্যতরী। ভ্রমণপিপাসু শত মানুষ রঙ বেরঙের পানসিতে করে এই নদীর বুকে প্রমোদ ভ্রমণে বের হতেন। শুধু তাই নয়, এই নদীকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল হাজারো কৃষক, জেলে আর কুমার সম্প্রদায়ের জীবিকা। আজ তা কালের গর্ভে বিলীন।

ময়লা পানিতে চলে কাজ। ছবি: আব্দুল আলিম
ময়লা পানিতে চলে কাজ। ছবি: আব্দুল আলিম

ইতিহাস বলে- উনিশশো পঞ্চাশ সালে আসামে ভুমিকম্পের পর যমুনা নদীর বিশাল পলি অবক্ষেপ তুরাগ নদী পর্যন্ত পড়ে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি দূষণের সুত্রপাত হয়। বর্তমানে এ নদীর পুরোটাই ভূমিদস্যুদের দখলে। পরিবেশ আইন অমান্য করে এ নদীর আশেপাশে সরকারি বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনা, পোশাক, কলকারখানা ইটের ভাটা আর বালু ব্যাবসার গদি গড়ে উঠেছে। যা থেকে প্রতিনিয়ত হাজারো টন অপরিশোধিত বর্জ্য মিশছে নদীর পানিতে। দূর্গন্ধময় কালো রঙের এই পানিকে পানি না বলে বরং ‘তরল বিষ’ বলাই শ্রেয়।

শুকনো মৌসুমে সরু হয়ে পড়লেও তুরাগ একটি সক্রীয় নদী। তাই এখনও আশাবাদ ব্যক্ত করা যায় যথাযথ পদক্ষেপ আর জনসচেতনতা থাকলে মৃতপ্রায় এই নদীতে পুনরায় প্রাণের স্পন্দন জাগানো সম্ভব।