'কিন্তু মাঝখানে যে কাঁটাতারের বেড়া'

‘কত দিন দেখিনি বাবাকে, চোখ বুজলেই তাঁর মুখটা ভেসে ওঠে। তাই দেখা পেতে এবার ছুটে এসেছি সীমান্তে, দেখাও পেয়েছি। মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে, শরীরটাও ভেঙে পড়েছে। দেখেই মনটা কেঁদে উঠল। একটুখানি ছুঁয়ে দেখতে বড়ই ইচ্ছে হলো, জড়িয়ে ধরতে হাত দুটিও বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু মাঝখানে যে কাঁটাতারের বেড়া, কিছুতেই বাবাকে ছুঁতে দিল না।’
গতকাল শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার গোবিন্দপুর সীমান্তে ভারতে বসবাস করা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে কথাগুলো বলছিলেন অন্নবালা রায়। হরিপুরের গোবিন্দপুর গ্রামে কুলিক নদের পাড়ে আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী পাথরকালী মেলা উপলক্ষে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কয়েক যুগ ধরে দুই বাংলার হাজারো মানুষ স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে কুশলবিনিময় করে আসছেন। গতকাল শুক্রবারও হূদয়ের টানে সীমান্ত এলাকার কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দুই বংলার মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন।
মেলার সভাপতি নগেন চন্দ্র পাল জানান, কয়েক যুগ ধরে গোবিন্দপুর গ্রামে কালীপূজা আয়োজন করছেন হিন্দু ধর্মীবলম্বীরা। আর কালীপূজার পরের শুক্রবার ওই এলাকায় বসে মেলা। পাথরে নির্মিত মূর্তির নাম অনুসারে মেলার নামকরণ হয় পাথরকালীর মেলা। তবে এ বছর খেতে পাকা ধান থাকায় মেলার তারিখ পিছিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। মেলাকে ঘিরে প্রতিবছর এক দিনের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এ সুযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষেরা কাঁটাতারের বেড়ার দুই ধারে দাঁড়িয়ে সহজেই দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা সেরে ফিরে যান। দুই বাংলার জনপ্রতিনিধিরা এ উদ্যোগ নেন।
গতকাল শুক্রবার গোবিন্দপুর সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ভারতে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে সকাল নয়টা থেকে তীব্র রোদ উপেক্ষা করে মেলায় ভিড় জমিয়েছেন বাংলাদেশের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। তাঁরা মেলায় ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র কিনছেন। অবশেষে বিকেল সোয়া তিনটা থেকে দেড় ঘণ্টায় তাঁরা স্বজনদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। বিনিময় করেন কাপড় ও খাদ্য। বিদায়ের সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের মিলিন চন্দ্র (৬০) স্ত্রীকে নিয়ে সীমান্তে এসেছেন ভারতের রায়গঞ্জের হেমতাবাদে বসবাস করা দুই মেয়ে বাসন্তী ও দেবশ্রীর সঙ্গে দেখা করতে। কাঁটাতারের বেড়ার পাশে মেয়েদের পেয়ে হাত বাড়িয়ে দেন। মিনিট দশেক কথা বলার পর হাতের চটের ব্যাগটি ছুড়ে দেন তাঁদের দিকে। মিলনের স্ত্রী অনিতা রানী জানান, বিশ বছর আগে তাঁর মেয়েদের বিয়ে হয় ভারতে। বছরের এই একটা দিনের অপেক্ষায় থাকেন দুই মেয়েকে দেখার জন্য। এরপর বাড়ি থেকে আনা খাদ্যসামগ্রী ছুড়ে দেন কাঁটাতারের ওপারে।
রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর থেকে মাধবী রানী (৩৯) এসেছেন ভারতের কাকরমনি গ্রামের বাসিন্দা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর এই প্রথম মাকে দেখলাম। অসুস্থ মাকে একনজর দেখে এলাম। এখন একটু শান্তি লাগছে।’ ভাতুরিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম প্রধান বলেন, অস্বচ্ছলতার কারণে যাঁরা পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে যেতে পারেন না, তাঁরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সারা বছর এই দিনের অপেক্ষায় থাকেন।