‘পানির মধ্যে ডুইবা আছি পাঁচ দিন ধইরা। ঘরের মধ্যে পানি, মাচা কইরা থাকতে হয়। উনান ডুইবা গেছে, রান্না করার উপায় নাই। বাথরুম করতে অন্যের বাড়িতে যাইতে হয়।’ এভাবে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন ফরিদপুর সদরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের মোস্তফাডাঙ্গি গ্রামের গৃহবধূ জ্যোৎস্না বেগম।
গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তা থেকে নেমে বাড়িতে যাওয়ার একটাই বাহন, নৌকা। ওই নৌকায় বাড়ি ফিরছিলেন জ্যোৎস্না। এলাকার ২৯টি পরিবার পানিতে ডুবে আছে। প্রত্যেক বাড়িতেই হাঁটুপানি। ঘরের মধ্যে মাচা বানিয়ে বসবাস করছে পরিবারের সদস্যরা।
হাঁটুপানি ভেঙে এগোতে এগোতে বৃদ্ধা সবুরা খাতুন বলেন, ‘আমরা পানিতে ডুইবা আছি। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার বা সরকারের কেউ আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি। বাড়িতে রান্ধাবাড়া বন্ধ। চিড়া মুড়ি খাইয়া না-খাইয়া বাঁইচা আছি।’ একই এলাকার বাসিন্দা স্বরূপজান বেগম বলেন, ‘বাথরুম করতে পরের বাড়ি যাইতে হয়। টিউবওয়েল তলায় যাওয়ায় খাবার পানির বড় কষ্ট। আমাগো দেখার কেউ নাই।’
পানি ঢুকেছে সদরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের সেলিম বিশ্বাসের ডাঙ্গী গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে। দেখা যায়, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে বাঁশের সাঁকো বানানো হয়েছে। ঘরের চকি ইট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। ওই গ্রামের কৃষক শেখ হবি বলেন, ‘পাঁচ দিন ধইরা ঘরে পানি ঢুকছে। রান্ধাবাড়ায় বেশি কষ্ট। ঘরের মধ্যে মাচা কইরা রানতে হয়। রাইতে সাপের ভয়।’
হবি শেখের ভাই হাতেম শেখ বেড়িবাঁধ এলাকায় মেয়ের বাড়িতে উঠেছেন বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে। তিনি তাঁর বড় ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন শ্বশুরবাড়িতে।
হবি শেখের স্ত্রী সখিনা বেগম বলেন, ‘বাথরুম সবচেয়ে বড় সমস্যা। দূরে যেসব বাড়িতে পানি ঢোকে নাই সেই সব বাড়িতে গিয়া বাথরুম করতে হয়। তারা বাথরুম ব্যবহার করতে দিতে না চাইলেও কিছু করার নাই। জোর কইরাই করতে হয়।’
স্কুলছাত্রী সুবর্ণা আক্তার বলে, ‘পানিতে তলায় যাওয়ায় স্কুলে যাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর সাপের ভয়ে রাইতে ঘুমাইতেও পারি না।’ ওই এলাকার বাসিন্দা ট্রাকচালক রহিম বিশ্বাস জানান, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের ঘরে পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় গবাদিপশু রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। মানুষ গরু-ছাগল নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করছে। তিনি বলেন, সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা থেকে কেউ তাঁদের জন্য ত্রাণ তো দূরের কথা, একটু খোঁজখবর নিতেও এগিয়ে আসেনি।
ওই এলাকার সিঅ্যান্ডবি ঘাট গোলডাঙ্গী সড়কের পাশে স্ত্রীকে নিয়ে আধা পাকা ধান ছড়াতে দেখা যায় সোহরউদ্দিন শেখকে। তিনি জানান, তাঁর ১ একর ১০ শতাংশ জমিতে আউশ ধান রোপণ করেছিলেন। ধান কেবল পাকতে শুরু করেছিল। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাত্র ৪০ শতাংশ জমির আধা পাকা ধান কাটতে পেরেছেন। তিনি বলেন, এই ৪০ শতাংশ জমি থেকে প্রায় ৯ মণ ধান পাওয়া যেত। এখন আড়াই মণ ধানও পাওয়া যাবে না।
ফরিদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রভাংশু সোম মহান বলেন, ফরিদপুর সদরের চারটি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। এসব ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানদের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করতে বলা হয়েছে। ‘আমরা ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বসে আছি’, মন্তব্য করে ইউএনও বলেন, ‘তালিকা হাতে না পাওয়ায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।’