'দূরে চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে'

সাদ্দাম হোসেন , মানফেজুল ইসলাম
সাদ্দাম হোসেন , মানফেজুল ইসলাম

‘দূরে চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে’।
সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার আগের দিন ফেসবুকে এ কথা লিখেছিলেন আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানফেজুল ইসলাম। বন্ধুরা তাঁকে ইভান নামেই চেনেন।
এমনই এক বন্ধু ফেসবুকে মন্তব্য লেখেন, ‘যত দূরেই যাও, ফিরে আসতে হবেই।’ প্রত্যুত্তরে ইভান লেখেন, ‘যদি মরে যাই!’
ইভান কি সত্যিই বুঝতে পেরেছিলেন, সেন্ট মার্টিনে গিয়ে তাঁকে মরতে হবে। নইলে এমন কথা তিনি কেন লিখলেন? আবার ইভানের বন্ধু সাব্বিরই বা কেন ফেসবুকে লিখলেন, ‘চলে যাচ্ছি, দোস্ত! একদম নেটওয়ার্কের বাইরে!!’
গত সোমবার নববর্ষের দিন সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে গিয়ে সাগরে নেমে নিখোঁজ হন ইভান, সাব্বিরসহ আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন ছাত্র। স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ। তাই নববর্ষ উদ্যাপনে ওঁরা ৩৪ বন্ধু দল বেঁধে গিয়েছিলেন কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনে।
কিন্তু উৎসব শেষ হলো বিষাদে। সাগরে নেমে লাশ হয়ে ফিরলেন সাদ্দাম হোসেন (২৩) ও মানফেজুল ইসলাম ইভান (২৩)। তাঁদের চার বন্ধু ইশতিয়াক বিন মাহমুদ, শাহরিয়ার ইসলাম, সাব্বির হাসান ও এস এম গোলাম রহিম এখনো নিখোঁজ। গত রাত পর্যন্ত তাঁদের খোঁজ মেলেনি। এঁদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। অন্য তিন বন্ধু ফয়সাল বিন হাবিব, আসিফ মুজতবা ও ফারহান-উল হক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সাদ্দামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তাঁরা সপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার পশ্চিম তেজতুরী বাজারে থাকেন। রাইফেলস কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ২০১০ সালের এপ্রিলে সাদ্দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
গতকাল দুপুরে তেজতুরী বাজারে সাদ্দামের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের আহাজারি করতে দেখা যায়। বাবা গোলাম ফারুক বললেন, ‘সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার আগে ছেলে তার মাকে বলে গেছে, “মাত্র তিন দিনের জন্য যাচ্ছি। ফিরে এসেই মাস্টার্সে ভর্তি হব।”’ কিন্তু মাকে ছেলের মৃত্যুর খবর দেখতে হয়েছে টেলিভিশনের পর্দায়। এর পর থেকে মা হেলেনা আক্তার বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। এমন মৃত্যু তিনি সইবেন কী করে?
গোলাম ফারুক জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আর কোনো ছেলে যেন এভাবে হারিয়ে না যায়। সেন্ট মার্টিনে যেন সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।’
ইভানের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। কাল বিকেলে সেখানে ইভানের লাশ পৌঁছলে স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাবা মকছুদুল আলম বলেন, ‘ইভান সাঁতার জানত না। তাই যাওয়ার আগে বলেছিলাম, সমুদ্রে যাচ্ছিস ভালো কথা, কিন্তু গোসল করতে নাইমো না। কিন্তু সমুদ্রে নামাটাই ওর কাল হলো।’ বাবা কথা বললেও ইভানের মা কিছুক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছেন।
সাদ্দাম ও ইভানের পরিবার তবু ছেলের লাশ বুঝে পেয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ পরিবারগুলো সেটাও পায়নি। নিখোঁজ সাব্বির হাসানের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। বাবা হাসানুর রহমান অতিরিক্ত সচিব ছিলেন, এখন অবসরে। থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে। তিনি জানান, তাঁর একমাত্র মেয়ে ডাক্তার। আর ছেলেকে প্রকৌশল পড়িয়েছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা অসাধারণ ছবি তুলত। এখনো আশা ছেড়ে দেইনি। লাশটা তো অন্তত পাব।’ তাঁর প্রশ্ন, পর্যটন এলাকায় কোনো সতর্কবার্তা নেই কেন?
সেন্ট মার্টিনে দুজন ছাত্র মারা গেছেন, কয়েকজন নিখোঁজ—টিভিতে এমন খবর দেখে বুকের ভেতরে কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে মাহমুদউল্লাহ গাজীর। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে ইশতিয়াক বিন মাহমুদকে ফোন দেন। অন্য একজন ফোন ধরে বলেন, ‘আঙ্কেল, ও গোসল করতে নেমেছে। আমরা ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ এ কথা শোনার পর থেকে ওর মা বিছানায়।
ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এভাবেই বললেন ইশতিয়াকের বাবা মাহমুদউল্লাহ গাজী। তিনি বলেন, তাঁর ছেলে সাঁতার জানত না। সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার আগে সাব্বিরসহ সবাই এসেছিলেন। তিনি ওঁদের বলেছিলেন, তাঁরা যেন সাগরে না নামেন। এ কথা বলেই কাঁদতে শুরু করেন বাবাব মাহমুদউল্লাহ।
নিখোঁজ শাহরিয়ার ইসলাম নোমানের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। এস এম গোলাম রহিমের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকায়। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সফর ছিল না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছেলেরা মিলে গিয়েছিল। তাই তাঁদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু মেধাবী এই ছেলেদের এমন দুঃখজনক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, হতাহতদের বন্ধু ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মইনুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উত্তর-পূর্ব ও জেটির উত্তর পাশের প্রিন্স হ্যাভেন পয়েন্ট দিয়ে সবাই মিলে গোসলে নামি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ হইচই। দেখি, কয়েকজন পানিতে ডুবে গেছে। পরে স্থানীয় লোকজন উদ্ধারকাজে অংশ নেয়।’
মইনুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাগরের ওই এলাকায় যে গভীর খাদ রয়েছে, সেটা আমরা জানতাম না। স্থানীয় প্রশাসন ওই এলাকায় কোনো ধরনের নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড টাঙায়নি। আর দুর্ঘটনায় পড়ে আমরা চিৎকার শুরু করলেও উদ্ধারের জন্য কোনো বাহিনী না থাকায় চোখের সামনেই আমরা বন্ধুদের মরতে দেখলাম।’
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, যে পয়েন্টে ওই ছাত্ররা গোসলে নেমেছিলেন, সেখানে পানির স্রোত ও একটি খাদ রয়েছে। ওই স্থানে পানির গভীরতা বেশি ছিল। আর তখন ভাটা থাকায় স্রোতের টানে হয়তো তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। এর আগেও ওই স্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সোহানসহ আটজন পর্যটক মারা গেছেন।