'বন্দুকযুদ্ধে' বরিশালে শীর্ষ সন্ত্রাসী পানামা ফারুক নিহত
বরিশাল নগরের একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ফারুক আহম্মেদ ওরফে পানামা ফারুক (৪৬) গতকাল সোমবার সকালে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তবে ফারুকের পরিবার বলছে, র্যাব তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে আগে অভিযোগ থাকলেও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন।
এদিকে যশোরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শাওন (২৬) নামের এক ব্যক্তি। গত রোববার রাতে যশোর শহরের বেজপাড়ার টিবি ক্লিনিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি, শাওনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ সাতটি মামলা রয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৮-এর লে. কমান্ডার মো. গুলজারের ভাষ্য অনুযায়ী, রোববার দিবাগত রাতে বরিশাল নগরের চকবাজার এলাকায় চেকপোস্ট বসান র্যাবের সদস্যরা। সকাল সোয়া ছয়টার দিকে ওই এলাকা দিয়ে ছয়-সাতজনের একটি দল যাচ্ছিল। তাদের থামতে বললে তারা উল্টো দিকে ঘুরে চলে যেতে থাকে। র্যাবের ডিএডি নাজির আহম্মেদ তাদের থামার নির্দেশ দিলেও তারা থামেনি। একপর্যায়ে তারা র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে নাজির আহম্মেদ আহত হন। এ সময় আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। দুই পক্ষে বন্দুকযুদ্ধের একপর্যায়ে মারা যান ফারুক আহম্মেদ। অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল, একটি কাটা রাইফেল, একটি পাইপগান, তিনটি ছোরা ও ৩৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহত ফারুকের ছোট ভাই মনা আহম্মেদ বলেন, তাঁর ভাই (ফারুক) গতকাল লঞ্চযোগে ঢাকা থেকে বরিশালে আসেন। বরিশালে নামার পর চকবাজার এলাকায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করে র্যাব। কোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। মনা আহম্মেদ বলেন, তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে একসময় অভিযোগ থাকলেও তিনি সেসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফারুক আগে সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের গত পাঁচ বছরে তাঁর বিরুদ্ধে তেমন প্রকাশ্য কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, ফারুকের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ ১০টি মামলা রয়েছে। তাঁর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। সেই সময়ে বরিশাল নগরে গড়ে ওঠা ‘আট বাহিনীর’ একটির প্রধান ছিলেন ফারুক। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে পালিয়ে যান। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ফারুক ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা দেশের বাইরে পলাতক ছিলেন।
১৯৯৬-২০০১ সালে তখনকার চিফ হুইপ বর্তমানে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর অনুসারী ফারুক ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতেন। বেপরোয়াভাবে প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও চাঁদাবাজি করতেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নগরের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। সেই সময় ফারুক একবার বরিশাল প্রেসক্লাবে হামলা চালিয়ে সাংবাদিকদের মারধর করেন। একে-৪৭ নিয়ে একাধিকবার নগরে মহড়া দেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে পানামা ফারুক, মো. জসিমউদ্দিন, কুতুব রানা, মামা খোকন, আবুল বাসার, মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে চুন্নু, মোনায়েমসহ আট বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিল নগরবাসী। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এসব সন্ত্রাসী ভারতে চলে যান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁরাও দেশে ফেরত আসেন। ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর ফারুক আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালতের নির্দেশে কিছুদিন কারাভোগের পর পরবর্তী সময়ে তিনি আবার জামিনে মুক্ত হন।
১৯৯৬ সালের আগে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফারুক। ওই বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি যুবলীগে যোগ দেন। বাজার রোড এলাকায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানামা ট্রেডার্সের মালিক ছিলেন তিনি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর নামের পেছনে ওই ‘পানামা’ বসে যায়। নাম হয় ‘পানামা ফারুক’।
যশোরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’: যশোরে গুলিবিদ্ধ শাওন বর্তমানে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি শহরের টিবি ক্লিনিক এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে।
পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, রোববার দুপুরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় পুলিশ টিবি ক্লিনিক এলাকা থেকে শাওনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁকে নিয়ে রাত দুইটার দিকে অস্ত্র উদ্ধারে শহরের টিবি ক্লিনিক এলাকায় যায় পুলিশ। টিবি ক্লিনিকের পূর্ব পাশে পৌঁছালে শাওনের সহযোগীরা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন ও বোমা হামলা চালান। এ সময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় একটি গুলি শাওনের পায়ে লাগে। অন্য সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেলে ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক ও বন্দুকের গুলি উদ্ধার করা হয়।
গত রাতে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ শাওনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিনিধির। এ সময় শাওন বলেন, ‘আমাকে দাঁড় করিয়ে পুলিশ পায়ে গুলি করেছে। পুলিশ নিজেরা অস্ত্র দিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।’
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি এমদাদুল হক শেখ বলেন, শাওনের বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক দ্রব্য, মারামারি, চাঁদাবাজিসহ সাতটি মামলা রয়েছে। তিনি যশোরের চিহ্নিত ছিনতাইকারী। ওসির দাবি, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় থানার কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলমের হাত ও পা বোমার স্প্লিন্টারে ঝলসে গেছে। তিনি জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করা হবে বলে তিনি জানান।