বর্ষবরণের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যৌন হয়রানির শিকার হন কয়েকজন নারী। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে তাঁদের রক্ষা করতে এগিয়ে যান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী। ঘণ্টা দেড়েকের সেই যুদ্ধে ডান হাত ভেঙে যায় তাঁর। গতকাল রোববার দুপুরে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে সেদিনের ঘটনার রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা দিয়েছেন তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আসিফুর রহমানের কাছে

প্রথম আলো: আপনি কীভাবে সেখানে উপস্থিত হলেন?
লিটন নন্দী: পয়লা বৈশাখের দিন বিকেলে আমরা ৮-১০ জন সিপিবি-বাসদের মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফীর প্রচারণা শেষে শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে রওনা হই। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তখন লোকে লোকারণ্য। টিএসসিতে পৌঁছে দেখি আমার সঙ্গে কেবল সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন সেনগুপ্ত ও কার্জন হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান আছে। বাকিরা ভিড়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
টিএসসির সামনে পৌঁছে দেখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে মানুষের ঢল। বের হচ্ছে, ঢুকছে। এর মধ্যে হঠাৎ দেখতে পেলাম কিছু যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভিড়ের মধ্যে নারীদের হয়রানি করছে। মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে মনে হলো ওরা বিচ্ছিন্ন না, প্ল্যানড গ্রুপ (সংঘবদ্ধ দল)। ঘুরেফিরে তারা ফটকের কাছে আসছে এবং চলাচলের পথটা আটকে নারীদের হেনস্তা করছে।
সুমনকে বললাম, সুমন এখানে ঝামেলা হচ্ছে, তুই আয়। এমন সময় হঠাৎ চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়েকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই জায়গায় গিয়ে ঠেলাধাক্কা দিয়ে, করিডর বানিয়ে মেয়েটাকে পথ করে দিলাম। কয়েকজনকে আমি বকাঝকাও করলাম। এই করতে করতেই তিন-চারটা ঘটনা ঘটল। আমরাও চেষ্টা করছি ওদের ঠেলা ও ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে নারীদের জন্য পথ তৈরি করে দিতে। একটা সময় মনে হলো, ওরা ঝাঁক বেঁধে আসছে। আমিও যেভাবে পারি লাথি, ঘুষি মেরে ফাঁকা জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো: সেখানকার উপস্থিত লোকজন কি আপনাদের সাহায্য করেনি?
লিটন নন্দী: হ্যাঁ। ওই অবস্থায় আমার সঙ্গে দুই-তিনজন বাইরের লোকও এলেন। একটা পর্যায়ে সেখানে লাঠি হাতে পুলিশের দুজন কনস্টেবলকে দেখলাম। আমি চিৎকার করে তাঁদের বলি, আপনারা ফোর্স আনান। দেখতে পাচ্ছি, গেটের উল্টো পাশে মিলন চত্বরে পুলিশ আছে, ডাচ্-বাংলা বুথের পাশেও আছে। আর কিছু লোক রাজু ভাস্কর্যের আইল্যান্ডে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে।
প্রথম আলো: আক্রমণকারী যুবকেরা কী করছিল?
লিটন নন্দী: আপনি যদি ঘটনার ভিডিও দেখেন, দেখবেন মানুষের কী স্রোত! আর এর মধ্যে ঘূর্ণির মতো যুবকেরা এসে মেয়েদের স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তার মধ্যেই চলে হেনস্তা। চারপাশ দিয়ে ধাক্কিয়ে একপাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দীর রাস্তায় এ অবস্থা, গেটে কী অবস্থা কে জানে।
কনস্টেবলদের বললাম, ঢোকার পথ বন্ধ করে দিন। সবাইকে শুধু বের হতে দিন। নয়তো মেয়েদের জন্য করিডর আলাদা করেন। তাঁরা বললেন, দেখছি।
এসব করছি। এর মধ্যে ছয়টার পরের দিকে রাজু ভাস্কর্যের দক্ষিণ পাশে একটা ভীষণ আর্তনাদ। ওমা, ওমা করে চিৎকার। আমার সঙ্গে যে দুজন ছিল, তাদের নিয়ে দৌড় দিলাম। বাইরের যাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরাও যোগ দিলেন। চড়-লাথি যা পেরেছি মেরে আমি ১০ সেকেন্ডের জন্য মেয়েটার সামনের জায়গা ফাঁকা করতে পারলাম।
মেয়েটার শাড়ি প্রায় পড়ে যাচ্ছে। ব্লাউজ ছিঁড়ে গেছে...। এখানে আক্রমণকারী মনে হলো ৩০-৪০ জন হবে। আসলে কোনো কিছু বুঝে ওঠার জো নেই। আমি আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকি, একটাও ধারে আসবি না। আমি দ্রুত আমার পাঞ্জাবি খুলে মেয়েটিকে দিলাম। তিনি ঝুঁকে এক হাতে মুখ ঢেকে ছিলেন। তাঁর সঙ্গের স্বজন ছেলেটা মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। ওই দুই পুলিশ কনস্টেবল বাঁশি বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে দেন। ওই দুজন পুলিশ সদস্যের নাম খেয়াল করতে পারিনি।
প্রথম আলো: এরপর মেয়েটি কোথায় গেল?
লিটন নন্দী: আমরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে একটা রিকশায় তুলে দিই। হুড তুলে তিনি শাড়ি গুছিয়ে আমার পাঞ্জাবিটা সুমনের হাতে ফেরত দিয়ে দেন। আমি পাঞ্জাবিটা আবার পরে নিই।
প্রথম আলো: এরপর আপনারা কী করলেন?
লিটন নন্দী: ওখান থেকে এসে সুমনকে টিএসসির ভেতরে পাঠালাম। বললাম কিছু বাঁশ নিয়ে আসতে। সে আরও সাত-আটজনকে নিয়ে আসে।
প্রথম আলো: এর মধ্যে কি আপনি বিশ্ববিদ্যালয় বা পুলিশের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?
লিটন নন্দী: আসলে ফোন করার তো ফুরসত পাইনি। সাড়ে ছয়টার দিকে আমার সঙ্গের ছেলেরা প্রক্টর স্যারকে ফোন দেয়। সাতটা বা সাড়ে সাতটার দিকে রাস্তায় বটগাছের দিকে আরেকটা মেয়েকে হামলার শিকার হতে দেখি। সে ছিল সতেরো-আঠারো বছরের কিশোরী। ওকে সেভ (রক্ষা) করতে গিয়েই আমি মাটিতে পড়ে যাই। আসলে ততক্ষণে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। ফলে যুবকদের ধাক্কায় পড়ে যাই। মেয়েটার সঙ্গে থাকা লোকটাকেও ওরা মারছিল। আমি পড়ে যাওয়ায় আমার গায়েও মার পড়ছিল। ওই সময়ই হয়তো হাতটা ভেঙে যায় আমার, তবে তখন টের পাইনি। আমি মাটিতে পড়ে গিয়ে হাতজোড় করে বলতে থাকি, ভাই, মেয়েটা মারা যাচ্ছে, ওকে বাঁচতে দেন। পাড়া খাচ্ছে। পরে দুজন পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে সিএনজিতে তুলে দেয়।
ততক্ষণে খবর পেয়ে আমাদের ১৫-১৬ জন কর্মী চলে এসেছে। হাত ফুলে গেছে আমার। গায়ে বলও নেই। আমি টিএসসির সামনে দোকানের দিকে যাই। ততক্ষণে পুলিশও এসেছে। আমি আমাদের সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের রুমে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসি। সেখান থেকেই সাতটা ২০ মিনিটের দিকে প্রক্টর স্যারকে ফোন দিই। বলি, স্যার, আপনার পায়ে ধরি, ওখানে পুলিশ ফোর্স পাঠান, অবস্থা খুব খারাপ। উনি আমাকে বলেন, ওখানে তো পুলিশ থাকার কথা। গেটটা তো বন্ধ থাকার কথা। আমি বললাম, এসব বলার এখন সময় নেই। আপনি পুলিশ পাঠান। তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিচ্ছি।
পরে আমাদের অন্য কর্মীরা চলে এলে আমি জিজ্ঞেস করি, প্রক্টর এসেছিলেন কি না বা প্রক্টরিয়াল বডির কোনো সদস্য? ওরা জানায়, কেউ আসেনি। আমি তাৎক্ষণিক কয়েকজন কর্মীকে প্রক্টরের কার্যালয়ে পাঠাই।
ওরা জিজ্ঞেস করেছে, ওখানে যাননি কেন? প্রক্টর বলেছেন, আমি ওখানে গিয়েই বা কী করতে পারতাম?
দুপুরের পরপরই কেন ক্যাম্পাসের ভেতরে গাড়ি ছাড়লেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, গাড়ি ছাড়ব কি ছাড়ব না, যাব কি না-যাব, তা তোমাদের কেন বলতে হবে?
প্রথম আলো: ওই মেয়েটার কী হলো? কোনো খবর পেয়েছেন বা নিয়েছেন?
লিটন নন্দী: প্রক্টরের কাছে নেতা-কর্মীদের পাঠিয়ে আমি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হই। দুজন ছিল আমার সঙ্গে। সুমন আর অমিত দে। পুলিশ যখন লাঠিপেটা করে অনেককে সরিয়ে দিচ্ছিল, তখন ছাত্র ইউনিয়নের রমনা থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক অমিত দে-ও আহত হয়েছে। টিএসসির গেটে দেখলাম একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে রিকশাওয়ালা যেতে অস্বীকৃতি জানায়। বলল, আপনারা উঠায়া দিছেন, ভাড়া দেয় নাই। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল? বলল, প্রথমে রোকেয়া হলের গেটে একবার নামছে। ভেতরে গিয়ে ১০-১৫ মিনিট পর আবার আসছে। পরে ধানমন্ডি গিয়ে নামায়া দিয়ে আসছি।
পরে ওই রিকশাওয়ালাকে নিয়েই ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। ৫০ টাকা ভাড়া দিলাম। আমাদের উদ্ধার করা সেই মেয়েটা যে রোকেয়া হলে গিয়েছিল, পরে খবর নিয়ে তা নিশ্চিত হয়েছি। ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইশাত কাশফিয়া ঘটনাটি প্রাধ্যক্ষ নাজমা শাহীনকে জানিয়েছেন। ম্যাডাম তা প্রক্টর স্যারকে জানিয়েছেন বলে শুনেছি।
প্রথম আলো: ঘটনার পাঁচ দিন পার হয়ে গেল। কেউ শনাক্ত হয়নি। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আপনি এখন পুরো বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
লিটন নন্দী: ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে অন্য আলোচনাই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্যাতনের মাত্রা কতটুকু। তাঁরা মনে করছেন কী? নারী যখন বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়াবে, তখন সেটাকে বীভৎস বলা হবে? তাঁরা কী ধরেই নিয়েছেন, এত বড় একটা প্রোগ্রাম হবে, এতটুকু যৌন নির্যাতন তো হবেই! মাত্রা মানেটা কী? ওখানে কি কাউকে ধর্ষিত হতে হবে? ভিডিও পাওয়া যেতে হবে?
প্রথম আলো: ঘটনাটি আপনার পরিকল্পিত মনে হলো কেন?
লিটন নন্দী: পর্যবেক্ষণ থেকেই আমি এটা বলছি। সেখানে একদল যুবকই বারবার একই ঘটনা ঘটাচ্ছিল।
প্রথম আলো: যুবকেরা দেখতে কেমন?
লিটন নন্দী: ওদের কেউ কেউ ভুভুজেলা বাজাচ্ছিল। এতে মেয়েদের কারও চিৎকার শোনা যাচ্ছিল না। আসলে পরে ভিডিও ফুটেজ দেখে তা বুঝলাম। তখন তো আর মাথায় কিছু ছিল না। একটা যুবক ছিল খুব স্মার্ট। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। আমার চেয়ে লম্বা। মার খেয়ে সে দৌড়ে চলে গেল। এমনও একটা কালপিটকে ধরি, বয়স পঞ্চান্নর বেশি হবে। প্রথমবার দেখছি, দ্বিতীয়বার দেখে ধরে ফেলি। শুধু বলেছি, একমুহূর্তও যাতে এখানে না দেখি!
প্রথম আলো: এখন সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কী বলবেন?
লিটন নন্দী: একটা বিষয় বলতে চাই। আমরা ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চাচ্ছি কেন? এই সংস্কৃতিতে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বা পুলিশের সুনাম বাড়বে না, ক্ষুণ্ন করবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
লিটন নন্দী: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।