
মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ...। এমন আহ্বান যিনি জানিয়েছেন, তিনি দ্বিজেন শর্মা। এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃক্ষের সতেজতা, সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকেছেন। সবুজ দেশ আর সবুজ মানুষ গড়তে কাজ করে চলেছেন। গাছ কাটা পড়ছে, পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। তারপরও বলা যায় তাঁর আহ্বান বৃথা যাচ্ছে না। একদিকে যখন পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ পরিবেশ রক্ষাকে আন্দোলনে রূপান্তর করতে পেরেছে।
দ্বিজেন শর্মার সার্থকতা এখানেই। ছোটবেলা থেকে গাছকে ভালোবেসেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে চলেছেন। একটা সময়ে এসে বুঝতে পেরেছেন, গাছের ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। একা পথচলায় সুফল আসবে না। সেই থেকে প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি। দা, কোদাল, কাঁচি নিয়ে বাগান করতে লেগে যাওয়া, অন্যকেও এই কাজে উৎসাহিত করা। এমন এক প্রকৃতিপ্রেমী নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা ৮৫ বছর পেরিয়েছেন। পড়েছেন ৮৬-তে। তাঁর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গণগ্রন্থাগারে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের। ‘বরেণ্য নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা জন্ম-উৎসব ও প্রকৃতি মেলা’ নামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দ্বিজেন শর্মা জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি।
সন্ধ্যায় নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় দ্বিজেন শর্মাকে। জীবনের এই বেলায় এসে প্রাপ্তি কী তা জানার আগ্রহ ছিল অনুষ্ঠানে আসা দর্শকদের। অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তরটা তাঁরা পেয়েছেন দ্বিজেন শর্মার কাছ থেকে নয়, বরং ৫৫ বছরের সঙ্গী তাঁর সহধর্মিণী দেবী শর্মার কাছ থেকে। দর্শকদের তিনি বললেন, স্বামীর গাছ ও প্রকৃতিপ্রেমের অনেক উদাহরণ তাঁর কাছে আছে। অনেক কাছ থেকে তিনি এগুলো দেখেছেন। তবে স্বামীর এই কাজে এখন অনেক বেশি অভিভূত হন তিনি। কেননা, এখনকার তরুণেরা তাঁকে অনুসরণ করেন। প্রকৃতি রক্ষার জন্য এখনকার তরুণেরা অনেক বেশি সচেতন। যেটা তিনি আগে দেখেননি। দর্শকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে স্বামীর জন্য গর্বের কথা বললেন খোলাখুলিভাবেই। তাঁর মতে, প্রকৃতি রক্ষায় স্বামীর চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে না। তরুণেরা এই আন্দোলন আরও এগিয়ে নেবেন।
গতকালের অনুষ্ঠানে দ্বিজেন শর্মার সহকর্মী, ছাত্রসহ অনেকেই এসেছিলেন। প্রায় সবাই জানালেন মানুষটির বৃক্ষ ও প্রকৃতিপ্রেমের কথা। কবি নির্মলেন্দু গুণ দ্বিজেন শর্মা ও দেবী শর্মাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। আর দ্বিজেন শর্মা খুব সংক্ষেপে বললেন কেন প্রকৃতি ও গাছকে রক্ষা করতে হবে।
দ্বিজেন শর্মা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, মানব সভ্যতা এখন বিপন্ন। প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মানুষ যেন প্রকৃতিকে বাদ দিয়েই চলতে চায়। মানুষের এই ব্যবহারে প্রকৃতি এখন রুষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি বলতে চাই, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে মানুষের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের আরেকটি নতুন করে সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান থাকবে।’
নাগরিক সংবর্ধনায় দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে লেখা প্রকৃতিপুত্র দ্বিজেন শর্মা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। দ্বিজেন শর্মাকে শুভেচ্ছা জানাতে সংবর্ধনায় উপস্থিত হন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, লেখক হায়াৎ মামুদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, আইইউসিএনের আবাসিক প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ, কুমুদিনী ট্রাস্টের পরিচালক প্রতিভা মুৎসুদ্দি, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, আলী যাকের, মফিদুল হক, ইনাম আল হক প্রমুখ।
এর আগে বেলা ১১টায় শুরু হওয়া দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী, প্রকৃতিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রকৃতি মেলা। মেলায় প্রকৃতিবিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা অংশ নেয়। দিনভর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ মেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।